আফগানিস্তানে দু-দশকব্যাপী মার্কিন সেনা আধিপত্যের ইতি?

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। তাসের ঘরের মতোই ধসে পড়েছিল আমেরিকার টুইন টাওয়ার। সব মিলিয়ে প্রাণ গিয়েছিল ৩ হাজার মানুষের। আহত হয়েছিলেন আরও ২৫ হাজার। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং পেন্টাগনে আল-কায়দা হানার ঠিক পরেই আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু বুশ। আফগানিস্তানের শান্তি ফেরাতে মূলত তালিবান-বিরোধী অভিযানেই সেনা নামিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারপর পেরিয়ে গেছে ১৯টা বছর। তবে রক্তক্ষয় আর না, জানিয়ে দিলেন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন। ঘোষণা করলেন, ৯/১১-র কুড়ি বছর পূর্তির আগেই আফগানিস্তান থেকে সমস্ত সেনা প্রত্যাহার করে নেবে আমেরিকা।

বুশের শাসন কালের পর বারাক ওবামার দায়িত্বে থাকাকালীন ২০০৯ সালে হোয়াইট হাউস আরও সেনাসংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফলত সেসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো’র সম্মিলিত সেনার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১ লক্ষ। ২০১৪ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইতি টানে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। তবে তার পরেও সেনা সরানো হয়নি সম্পূর্ণভাবে। প্রতিশ্রুতি দিয়েও আফগান প্রেসিডেন্টের অনুরোধেই সেনা-প্রত্যাহারের সময়সীমা বর্ধিত করেছিলেন ওবামা। শাসনের একেবারে শেষলগ্নে এসে ট্রাম্প সেই পথে হাঁটা লাগালেও, ব্যর্থ হয়েছিলেন সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারে।

হিসেব বলছে, বিগত ২০ বছরের যুদ্ধে আফগানিস্তানে নিহত হয়েছেন ২২০০-র বেশি মার্কিন সেনা। আহতের সংখ্যা কুড়ি সহস্রাধিক। আর দুই দশক-জুড়ে চলতে থাকা এই অভিযানে সব মিলিয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এককথায়, তালিবানকে সায়েস্তা করতে গিয়ে যে বেশ বড়ো অঙ্কের ক্ষতি হয়ে গেছে মার্কিন মুলুকে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। আর সেখান থেকেই সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাইডেনের।

তবে শুধু আফগানিস্তানই নয়, আল-কায়দা এবং আইসিসের বিরুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে মার্কিন বাহিনী মোতায়েন রয়েছে, তাও ধীরে ধীরে ফিরিয়ে আনবেন বাইডেন। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে নিজের প্রভাব কমিয়ে নিরস্ত্র হওয়ার পরিকল্পনাই করছেন তিনি, তা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টই। 

আরও পড়ুন
চুরি হয়ে যাওয়া সামগ্রী থেকেই তৈরি হচ্ছে আফগানিস্তানের নতুন ইতিহাস

যদিও সেনা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করলেও, পারতপক্ষে আফগানিস্তানে অবস্থানের সময়সীমা খানিকটা বাড়িয়েই নিলেন বাইডেন। এর আগে ট্রাম্প ঘোষ করে গিয়েছলেন ২০২১ সালের মে-র মধ্যেই সরিয়ে নেওয়া হবে সমস্ত সেনা। কিন্তু ৯/১১-র বর্ষপূর্তির আগে হচ্ছে না তেমনটা। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে হঠাৎ সেনা প্রত্যাহারে তালিবান আক্রমণের শিকার হতে পারেন অবস্থানরত মার্কিন সেনারা। পাশাপাশি তালিবানকে হুঁশিয়ারিও দিয়ে রাখা হয়েছে, আক্রমণ করলেন প্রত্যাঘাতের জন্য প্রস্তুত থাকতে।

আরও পড়ুন
আফগানিস্তানের বুকে নিজস্ব ট্যাটু পার্লার, ‘স্বাধীনতা’র লড়াই সোরায়া শাহিদির

তবে আমেরিকার নিষ্ক্রিয়তার পুরো ফায়দা তুলতে প্রস্তুত তালিবান। আফগানিস্তানে আবার ইসলাম শাসন ক্ষমতায় আসতে চলেছে সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছেন তালিবান নেতারা। আর এই ঘোষণাই নতুন করে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয় দেশগুলির প্রশাসনের। বিশেষত ভারতের কূটনীতিবিদরা মনে করছেন বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেশের নিরাপত্তাও। মনে করা হচ্ছে, আফগানিস্তান তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে এলে শক্তি বৃদ্ধি হবে পাকিস্তানের। ফলত সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়তে পারে দেশজুড়ে।

আরও পড়ুন
হাসপাতালে যেতে ‘অনুমতি’ চাই স্বামীর, আফগানিস্তানের এক অন্তঃসত্ত্বার গল্প এমনই

অন্যদিকে আমেরিকার এই অবস্থানকে তুরস্কের সমর্থন করাকেও ভালো চোখে দেখছে না দিল্লি। কারণ, বিগত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মঞ্চতেই তুরস্ক এবং পাকিস্তান সরব হয়েছিল ভারতের একাধিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। কাজেই আমেরিকার অসামরিক অবস্থান শুধু আফগান নয়, ভারতের পরিস্থিতিকেও যথেষ্ট প্রভাবিত করবে। তবে এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই এ মাসের ২৪ তারিখ আফগানিস্তানে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে চলেছে ভারত। তুরস্কের আয়োজিত সেই সম্মেলনে উপস্থিত থাকবে বিশ্বের মোট ২০টি শক্তিধর দেশ। এখন দেখার সেই আলোচনা পর্ব ঘিরেই নতুন মোড় ঘোরায় কিনা আন্তর্জাতিক রাজনীতি…

Powered by Froala Editor

Latest News See More