বছর খানেক আগের কথা। জর্জ ফ্লয়েড হত্যায় বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সোশ্যাল মিডিয়া। আর তারপরই ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’-র নাম বদলে ফেলেছিল হিন্দুস্তান ইউনিলিভার। কিন্তু নাম বদলালেও পণ্যের গুণগত মান কি বদলেছে আদৌ? না, বদলে এখন এই ধরনের ফেয়ারনেস ক্রিমকে (Fairness Cream) বলা হচ্ছে ত্বক উজ্জ্বল করার প্রসাধনী। বদলায়নি সমাজের মানসিকতাও। একুশ শতকে দাঁড়িয়েও পিতৃতন্ত্র এবং বর্ণবাদ জড়িয়ে রয়েছে মানুষের জীবনে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লড়ছেন মার্কিন আইনজীবী আমিরা অ্যাডাওয়ে (Amira Adawe)।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা হলেও আমিরার জন্ম সোমালিয়ায়। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে ছোটো থেকেই বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন আমিরা। প্রতিবেশিদের কাছ থেকে প্রায়শই ভেসে আসত কটূক্তি। ফেয়ারনেস ক্রিম মাখার পরামর্শ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবা-মায়ের চাপে কখনও কখনও সেসব ব্যবহারও করতে হয়েছে তাঁকে। আমিরা বুঝে গিয়েছিলেন চামড়ার রং-ই সমাজের কাছে মানুষের নীতিনির্ধারক। পরবর্তীকালে আমেরিকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর বর্ণবৈষম্যের এই কঠিন বাস্তবের ছবি আরও প্রকট হয়ে ওঠে তাঁর সামনে। আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া তখন থেকেই।
কিন্তু এই ক্রিমের বিশেষত্ব কী? চামড়ার রঙের প্রতি সমাজের বদ্ধমূল মানসিকতায় উৎপাদক সংস্থাগুলির ভূমিকাই বা কতটুকু? এইসব প্রশ্নই বার বার ভাবিয়েছে তাঁকে। সেই উত্তর খুঁজতেই ২০০০ সালে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রসাধনী দ্রব্যের ওপর বিশেষ কোর্সে ভর্তি হন আমিরা। বিস্তারিত পড়াশোনা করেন ফেয়ারনেস ক্রিম নিয়ে।
সেসময় অধ্যায়ন করতে গিয়েই আমিরা টের পান, শুধু বৈষম্যের প্রাচীর তুলে দিচ্ছে না এই ফেয়ারনেস ক্রিম। ‘শ্বেতাঙ্গ’ হয়ে ওঠার এই পথ স্বাস্থ্যের পক্ষেও ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিকর। আমিরার অনুসন্ধানে উঠে আসে, এই ধরনের ক্রিমে ব্যবহৃত হয় পারদ-সহ একাধিক ক্ষতিকর ধাতু। ত্বকের রং মূলত নির্ভর করে মেলানিন নামক একটি জৈব পদার্থের ওপর। সেই মেলানিনকেই দ্রুত ভেঙে ফেলে ফেয়ারনেস ক্রিম। ত্বকের রং বদলালেও, তার জন্য বাড়তে থাকে স্কিন ক্যানসারের সম্ভাবনা। সেইসঙ্গে পারদ ও অন্যান্য ভারি ধাতুর যৌগ ত্বকের প্রদাহ, অ্যালার্জি-সহ একাধিক অসুস্থতার দরজা খুলে দেয়। তবে সবথেকে আশঙ্কার বিষয় হল, এই ধরনের রোগগুলি স্থানান্তরিত হতে পারে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও।
আরও পড়ুন
বর্ণবিদ্বেষ, সামাজিক হেনস্থা ও এক 'কৃষ্ণকলি'র কাহিনি
আমিরার সমীক্ষায় উঠে আসছে, শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে ৮.৬ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে ফেয়ারনেস ক্রিম প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি। আরও ভয়াবহ অবস্থা আফ্রিকা ও এশিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও, বাস্তব পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ করতে ইউরোপ, দুবাই, চিন ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও নিজে গিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছেন আমিরা। বছর দশেক আগে, ফেয়ারনেস ক্রিমের এই ‘আনফেয়ার’ বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে লড়তেই ‘দ্য বিউটিওয়েল’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরি করেন। প্রতিবাদ, রেডিও-তে সচেতনতামূলক প্রচারের সঙ্গে আইনি পথেও লড়ে যাচ্ছেন তিনি। এই লড়াই হয়তো জারি থাকবে ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিক মানসিকতায় বদল না এলে কি আদৌ বদলাবে পরিস্থিতি? থেকে যায় সেই প্রশ্নই…
আরও পড়ুন
বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে একজোট এশিয়-আমেরিকান শিল্পীরা, চলছে সচেতনতামূলক প্রচার
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
পুলিশের গুলিতে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ যুবক, ফের বর্ণবিদ্বেষে রক্তাক্ত জর্জ ফ্লয়েডের শহর