‘অপরাধ’ চিনে জন্মগ্রহণ করা, ’৬২-র যুদ্ধে গুপ্তচর সন্দেহে বন্দি ৩০০০ চিনা-ভারতীয়

৫৮ বছর আগেকার কথা। আজও চোখ বন্ধ করলেই অনেকের মনে পড়ে সেদিনের সেই দৃশ্য। রাজস্থানের বালিঘেরা প্রান্তর দিয়ে ছুটে চলেছে রেলগাড়ি। প্রতিটি কামরায় বন্দি অসংখ্য চিন দেশের নাগরিক। আর আছে অল্প কিছু সংখ্যক ভারতীয় সেনা। মাঝে মাঝে একেকটি স্টেশনে থামছে গাড়ি। যাত্রীরা নেমে কেউ মাথা ধুয়ে নিচ্ছেন, কেউ গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন। হঠাৎ একটি স্টেশনে শুরু হল গণ্ডগোল। কোত্থেকে যেন কাতারে কাতারে জড়ো হলেন গ্রামবাসীরা। কারোর হাতে ঝাঁটা, কেউ ছুঁড়ছেন ইঁটের টুকরো। প্রত্যেকেই চিৎকার করে বলছেন, 'গো ব্যাক টু চায়না'।

সেদিনের মতো আবারও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই দেশ। আবারও উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন ভারতের বহু মানুষ। চিনের পরিস্থিতিও সম্ভবত একইরকম। দুদেশের রাষ্ট্রশক্তির মতোই দুদেশের মানুষও নিজেদের শত্রু মনে করছেন। তাই আতঙ্কে দিন গুনছেন প্রবাসী মানুষরা। আর এর মধ্যেই অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল ১৯৬২ সালের ইন্টার্নমেন্ট সেন্টারের ঘটনা। কী হয়েছিল ১৯৬২ সালে? 

সেই রেলগাড়ির প্রতিটি চিনা যাত্রীকে উদ্ধার করেছিল ভারতীয় সেনা। অবশ্য তারপর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিশেষভাবে তৈরি জেলখানায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধীদের বন্দি করা জন্য তৈরি জেলখানাগুলো আবারও ভরে উঠল সেবার। বন্দি প্রায় ৩ হাজার চিনা-ভারতীয়। হ্যাঁ, চিনা-ভারতীয় এই বিশেষণটাই তাঁদের জন্য ব্যবহার করা উচিত। কারণ জন্মসূত্রে চিনা হলেও দীর্ঘদিন এদেশে থাকার সূত্রে ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন তাঁরা। হিন্দিই ছিল অনেকের দৈনন্দিন কথোপকথনের ভাষা। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কেউ কেউ গুনগুন করে ভাঁজতেন হিন্দি গানের সুর। তাঁদের এমন ব্যবহার দেখে চমকে গিয়েছিলেন ভারতীয় সৈন্যরাও। আর এইসব মানুষও অবাক হয়ে দেখেছিলেন, তাঁদের বন্দি করতে আসা সেনারা তাঁদের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানেন না। শুধু জানেন তাঁরা জন্মসূত্রে চিনা।

ভারতের জেলখানায় বন্দি ৩ হাজার মানুষের একমাত্র অপরাধ, তাঁরা চিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অতএব সীমান্ত সংঘর্ষে যে তাঁরা গোপনে চিনের গুপ্তচরের কাজ করবেন না, সেকথা তো হলফ করে বলা যায় না। আর এই অপরাধীদের তালিকায় ছিল ৫ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ প্রত্যেকেই। মেয়েদের জন্য ছিল পৃথক বন্দিশালা। আর অন্য বন্দিশালায় রাখা হত পুরুষ এবং শিশুদের। যে শিশুদের অনেকেই তাদের অপরাধ বুঝতে পারেনি। অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছে তার বাবার দিকে। বাবা কি কাউকে খুন করেছে?

আরও পড়ুন
সাম্যবাদের মৃত্যু ঘটেছে চিনে, জন্ম নেবে ‘নিও-কমিউনিজম’; বলছেন স্লাভোয় জিজেক

১৯৬২ সালের ইন্টার্নমেন্ট সেন্টার বলতেই রাজস্থানের দেওলি প্রদেশের কথা মনে পড়ে। সবথেকে বেশি সংখ্যক বন্দি ছিলেন সেখানেই। তবে ভারতের প্রায় সব জায়গাতেই বন্দি চিনাদের সহ্য করতে হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর অত্যাচার। অবশ্য জেলখানায় হয়তো একরকম তাঁরা নিরাপদ ছিলেন। বাইরের জাতিবিদ্বেষী পরিস্থিতিতে হয়তো প্রাণ হারাতে হত অনেককে। জেলের ভিতর সেটুকু সুরক্ষিত ছিল। যা ছিল না, তা হল সম্মান, মর্যাদা আর অধিকার। প্রত্যেকেই বেঁচে ছিলেন, তবে মানুষের মতো নয়। খামারের জন্তুর মতো।

আরও পড়ুন
মৃত্যুর পরও ভারত-চিন সীমান্ত ‘পাহারা’ দেন হরভজন সিং, সতর্ক করেন সৈন্যদের!

আসাম, মেঘালয়, পাঞ্জাব, কেরালা ভারতের প্রতিটি প্রান্তে বন্দি হয়েছিলেন চিনা মানুষরা। কিন্তু এত সতর্কতা নিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত চিনের কাছে চূড়ান্ত পরাজয় স্বীকার করতে হয় ভারতকে। এবং শেষ পর্যন্ত সন্ধির শর্ত অনুযায়ী প্রত্যেককেই মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ভারত সরকার। খাতায় কলমে সেদিন তাঁদের যুদ্ধাপরাধী বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের সঙ্গে তাঁদের প্রকৃত কোনো যোগাযোগই ছিল না। অপরাধ ছিল শুধু জন্মের। এভাবেই একেকটা যুদ্ধ হয়তো বদলে দেয় অসংখ্য মানুষের জীবন। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর বন্দিদের অনেকেই আর এদেশে থাকার সাহস পেলেন না। কেউ ফিরে গেলেন চিনে, কেউ চলে গেলেন অন্য কোনো দেশে। কিন্তু এদেশের সংস্কৃতিটা কোথাও যেন আজও তাঁদের সঙ্গে থেকে গিয়েছে। তাই হংকং বা বেজিংয়ের রাস্তায় আজও কেউ গুনগুন করে ওঠেন বলিউডের প্রথম অধ্যায়ের কিছু জনপ্রিয় গান। গানের তো কোনো কাঁটাতার থাকে না।

আরও পড়ুন
৫০ বছর ধরে চিন থেকে সম্প্রচারিত হচ্ছে বাংলা সংবাদ, বেজে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতও!

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
২৪২ বছর আগে বাংলায় চিনা উপনিবেশ, অধরাই রইল ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ তৈরির পরিকল্পনা

More From Author See More

Latest News See More