ভারত-চিন যুদ্ধে, চিনা সৈন্যদের একাই আটকে দিয়েছিলেন ‘রাইফেলম্যান’ যশবন্ত

তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। আকাশে সামান্য লালের আভাস। প্রায় সবটাই অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের মধ্যেই অরুণাচলের সীমানা পেরিয়ে একটু একটু করে ভারতের দিকে গুঁড়ি মেরে আসছে চিনের সেনাবাহিনী। এটা তাদের চতুর্থ সংঘর্ষ। এর আগের সংঘর্ষেই পেয়েছে এক বিরাট সাফল্য। চিনের সেনাবাহিনী পৌঁছে গিয়েছে তাওয়াং এর বুদ্ধমন্দির পর্যন্ত। তুলে নিয়ে গিয়েছে মূর্তিটিও।

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের গুপ্তচর তিনি, মৃত্যু জার্মানদের হাতে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত নূরের সম্মানে ব্লু প্লাক

ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর ৫টা। চিনের সেনাবাহিনী আবার সংঘর্ষের আহ্বান জানাল। তারা তো প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষকে যেন ঠিক আগের মতো লাগছে না। প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পায়নি বটে, কিন্তু একচুল জমি ছেড়ে দিতে রাজি নয়। বিশেষ করে গারোয়াল রাইফেলের চার নম্বর রেজিমেন্টের একজন ফৌজিকেই চোখে পড়ছে। সবাই পিছু হটলেও নিজের কাজে অবিচল তিনি।

আরও পড়ুন
মহরমের যুদ্ধে হুসেনদের সঙ্গে প্রাণ দিয়েছিলেন এই হিন্দু ব্রাহ্মণরাও

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেই রাইফেলম্যানের নাম যশবন্ত সিং রাওয়াত। তাঁর অনুপস্থিতিতে হয়তো চিন-ভারত যুদ্ধের ইতিহাসটাই অন্যরকম হত। ১৯৬২ সালে নরানাং উপত্যকার সেই যুদ্ধই যেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে প্রথম আশার আলো ছিল। নাহলে যুদ্ধে পরাজয়ই ভবিতব্য, এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন সবাই। যুদ্ধ চলেছিল টানা ৭২ ঘণ্টা। কখনো পায়ের কাছে পড়ছে গ্রেনেড, ঘাড়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মেশিন গানের গুলি। এর মধ্যে বহুবার গুলি শেষ হয়ে যায় যশবন্ত সিং-এরও। প্রতিপক্ষের মৃত সৈনিকদের কাছে ছুটে গিয়ে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছেন বন্দুক।

আরও পড়ুন
জাপানি বোমা থেকে আমেরিকান সেনার দখলদারি – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী কলকাতা বন্দরও

তাঁর সহযোদ্ধারা কেউই টিকে থাকতে পারেনি। কিন্তু একা অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে যশবন্ত সিং। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে দুই স্থানীয় বালিকা সেলা ও নুরা। ভারতের সেনাবাহিনীর বাকি ফৌজরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছোন, তখন ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় ঠান্ডায় জমে গিয়েছে যশবন্তের রক্তাক্ত দেহ। তবে এর মধ্যেই ৩০০ জনের বেশি চিনা সৈন্যকে একা হাতে প্রতিহত করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন
ক্রিসমাসের দিন, বন্দুক নামিয়ে বিশ্বযুদ্ধের ময়দানেই আলিঙ্গন দুই প্রতিপক্ষের

যশবন্তের এই বিরল আত্মত্যাগ সবাইকেই মুগ্ধ করেছিল। সরকারের কাছ থেকে সম্মানও কম পাননি। মৃত্যুর পর পেয়েছিলেন মহাবীরচক্র সম্মান। পাহাড়ের উপর যে জায়গাটাতে তিনি মারা গিয়েছিলেন, সেখানে এখনও তাঁর নামাঙ্কিত কুটির সাজানো আছে। নিয়ম করে পরিষ্কার করা হয় তাঁর জুতোও। কিন্তু এসবের মধ্যে সাধারণ মানুষ আর তাঁকে কতটুকুই বা মনে রেখেছে? গতবছর তাঁর স্মরণে একটা সিনেমাও তৈরি করেছে বলিউড। আমাদের কি মনের মধ্যে কোনো প্রশ্ন জেগেছে তাঁর সম্বন্ধে? নাকি আমাদের সুরক্ষার জন্য এই মানুষরা নিজেদের জীবন দিয়ে যাবেন, অথচ আমরা সেদিকে ফিরেও তাকাবো না!