আজ থেকে ২০০০ বছর আগে ভাষা সংরক্ষণের নজির গড়েন এই মেসোপটেমিয়ান ব্যক্তি

প্রাচীন মেসোপটেমিয়া (Mesopotamia) সভ্যতার বোর্সিপা শহরের ছোট্ট একটি মন্দির। বর্তমান যা অবস্থিত ইরাকে। বছর কয়েক আগে সেখানেই মাটির তৈরি বেশ কিছু ট্যাবলেট খুঁজে পেয়েছিলেন নৃতাত্ত্বিকরা। না, কোনো গান, কবিতা কিংবা পৌরাণিক কাহিনি নয়; এই লেখার বিষয়বস্তু ছিল মদ প্রস্তুত করার পদ্ধতি। যেন আগামী প্রজন্মকে এই বিশেষ বিদ্যার প্রশিক্ষণ দিতেই লেখক লিপিবদ্ধ করেন সেই প্রক্রিয়া। শিলালিপির বর্ণনা অনুযায়ী, এই ব্যক্তির নাম নবু-কুসুরশু (Nabu Kusurshu)। 

তবে ব্যাপারটা অত সহজ নয় একেবারেই। অন্তত সাম্প্রতিক গবেষণায় জানাচ্ছে তেমনটাই। শুধু মদ তৈরির প্রক্রিয়ার নথিকরন নয়, বরং ভাষা সংরক্ষণের জন্যই এই পথে হেঁটেছিলেন তিনি। হ্যাঁ, আজ থেকে দু-হাজার বছর আছে ভাষা সংরক্ষণ! ভাবলে একটু অবাকই হতে হয় বৈকি। 

আদতে ট্যাবলেটগুলি লেখা হয়েছিল প্রাচীন কিউনিফর্ম (Cuneiform) লিপিতে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে এই লিপির ব্যবহার শুরু করেছিলেন সুমেরিয়ানরা। আনুমানিক প্রথম শতক পর্যন্ত প্রচলন ছিল এই লিপির। অর্থাৎ, দেখতে গেলে নবু কুসুরশুর সময়ে একপ্রকার অচল ভাষাতেই পরিণত হয়েছে কিউনিফর্ম। বদলে সে-সময়ে মেসোপটেমিয়া-জুড়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত অ্যাকেডিয়ান বা অ্যারামিক ভাষা। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন প্রাচীন এই ভাষায় ট্যাবলেট রচনার দিকে হেঁটেছিলেন তিনি? 

এই রহস্যেরই সমাধান মিলল সাম্প্রতিক গবেষণায়। আদতে এই রচনা তাঁর না। বরং, প্রাচীন কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা বেশ কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত ট্যাবলেটের লেখাকেই নতুন করে শিলালিপির রূপ দেন নবু। সেগুলি হয়তো লেখা হয়েছিল আরও হাজার তিনেক বছর আগে। যে ভাষা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে কালের আবহে, তার সংরক্ষণের জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নবু। এমনটাই বক্তব্য গবেষকদের। কারণ শুধু মদ তৈরির প্রক্রিয়াই নয়, একই সঙ্গে সুমেরিয়ান ও অ্যাকেডিয়ান ভাষার দ্বিভাষিক শব্দকোষও তৈরি করেছিলেন অনূর্ধ্ব ৩০-এর মেসোপটেমিয়ান তরুণ। লিপিবদ্ধ করেছিলেন দুই ভাষার সমতুল্য সাংকেতিক চিহ্নদের। তারপর সযত্নে সেই ট্যাবলেটগুলি প্রতিস্থাপিত করেছিলেন বোর্সিপার মন্দিরটিতে। অর্থাৎ, পরবর্তী প্রজন্মকে মৃতপ্রায় ভাষাটির সম্পর্কে অবগত করাই ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। 

আরও পড়ুন
গণ-আত্মহত্যার মুখে মানব সভ্যতা!

উনিশ শতকের শেষের দিক থেকেই মেসোপটেমিয়া সভ্যতার ভাষা নিয়ে চর্চা শুরু হয় বিশ্বের নানান প্রান্তে। শুরু হয় অনুবাদের প্রচেষ্টা। তবে ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রায় সকলেই। কারণ সুমেরিয়ান ভাষা অর্থাৎ কিউনিফর্ম লিপি পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্যদিকে অ্যাকেডিয়ান ভাষার সঙ্গে আরবি কিংবা হিব্রুর মিল থাকায়, পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় এই ভাষার। 

আরও পড়ুন
গহীন আমাজনে প্রাচীন সভ্যতা! প্রমাণ পেলেন গবেষকরা

পরবর্তীতে নবুর তৈরি ট্যাবলেটগুলির সৌজন্যেই পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় কিউনিফর্ম শিলালিপির। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ভাষাবিদ জে ক্রিসোস্টোমোর মতে, সম্পূর্ণ না হলেও, সুমেরিয়ান ভাষার এক-চতুর্থাংশ শব্দকোষের নথিকরন করে গিয়েছিলেন নবু। যার গুরুত্ব অপরিসীম। 

আরও পড়ুন
ধ্বংসের থেকে ১০০ সেকেন্ড দূরে মানব সভ্যতা, বলছে ডুমসডে ক্লক

আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে, প্রতি বছরে মৃত্যু ঘটছে ৯টি করে ভাষার। অর্থাৎ, ৪০ দিন অন্তর হারিয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা। অথচ, সেগুলি সংরক্ষণের জন্য সেভাবে কি কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে আজকের সভ্যতা? ভাষাবিদরা লড়ছেন ঠিকই, কিন্তু তা-সত্ত্বেও সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না বহু ভাষারই। সেখানে দাঁড়িয়ে আজ থেকে দু-হাজার বছর আগের এমন একটি প্রয়াস চুপ করিয়ে দেয় যে-কাউকেই…

Powered by Froala Editor