সিন্ধু সভ্যতায় দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষা-ব্যবহার, হদিশ দিলেন বাঙালি গবেষক

ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে প্রাচীনতম নাগরিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সিন্ধু নদের তীরে। অথচ গত ১০০ বছরের গবেষণায় তার রহস্যের মীমাংসা হওয়া তো দূরের কথা, বরং তা আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস যেমন রহস্যময়, তার পরবর্তী ইতিহাসও কম রহস্যময় নয়। বিশেষ করে, এই সভ্যতা ধ্বংসের পর সেখানকার অধিবাসীরা কোথায় গেলেন, কীভাবে সেখানে আর্য সভ্যতা গড়ে উঠল এবং সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্য আদৌ শেষ হয়ে গিয়েছে কিনা – কোনো প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর নেই ঐতিহাসিকদের কাছে। দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গেও কি কোনো যোগ ছিল এই সভ্যতার? এই নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। এর মধ্যেই সাম্প্রতিকতম গবেষণায় সেই যোগসূত্রটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বলেই দাবি করছেন গবেষক বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়।

সম্প্রতি নেচার গ্রুপের পত্রিকা ‘হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড স্যোসাল সায়েন্সেস কমিউনিকেশন’-এ প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণাপত্র। মূলত ভাষাগত দিক দিয়ে বহতা দেখিয়েছেন, সিন্ধু সভ্যতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রাক-দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলতেন লোকজন। এখানে অবশ্য একটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন, হরপ্পা বা মহেঞ্জোদাড়ো থেকে প্রাপ্ত লিপির পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি। ফলে সেই সময়ের ভাষা সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনো ধারণাও নেই। গবেষণার ক্ষেত্রে তাই ভরসা কেবল কিছু প্রোটো-শব্দ। যার মধ্যে মূলত হাতির সমার্থক ‘পিলু’ শব্দটির উপরেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বহতা। শুধুই সিন্ধু উপত্যকায় নয়, প্রাচীন ব্যাবিলন বা ব্যাক্ট্রিয় সভ্যতাতেও অনুরূপ শব্দের ব্যবহার রয়েছে বলেই প্রমাণ করেছেন তিনি। তবে এই শব্দটি সম্ভবত হাতি প্রাণীটিকে বোঝাতে প্রথম ব্যবহৃত হয়নি। বরং তার সঙ্গে দাঁতের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। এমনকি আরব ভূখণ্ডে দাঁতন হিসাবে ব্যবহৃত গাছের নামকরণেও ‘পিলু’ শব্দটির প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

বহতা অংশুমালীর মতে, সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের জেরেই এইসমস্ত অঞ্চলে কিছু শব্দ ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে তা ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যেও গৃহীত হয়। যেখান থেকে প্রাচীন আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও বেশ কিছু গাছের নামকরণের সঙ্গে ‘পিলু’ শব্দটি জড়িয়ে যায়। যদিও অংশুমালী এখানে সতর্ক করে দিয়েছেন একটি বিষয়ে। তাঁর মতে, প্রায় ৫ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত একটি সভ্যতার সমস্ত মানুষ কখনোই একটি মূল ভাষায় কথা বলতেন না। সেখানে ভাষাগত বৈচিত্র ছিলই। তার সমস্ত অংশের সঙ্গে যে প্রাক-দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর যোগাযোগ ছিল, এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা সম্ভব নয়। এমনকি প্রাক-দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর অংশও হয়তো ছিলেন না কেউই। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যে দ্রাবিড় সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ ছিল, সেটা প্রমাণ করাই তাঁর উদ্দেশ্য। আর এইসমস্ত তথ্যপ্রমাণের সূত্র ধরে হয়তো এই সভ্যতার ধ্বংসের ইতিহাসটাও ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More