অস্কারের মনোনয়নে প্রথম সিনেমাই; রক্ত দিয়ে চিঠি লিখতেন মহিলা-ভক্তরা!

সালটা ১৯৬৫। ফিল্মফেয়ার এবং ইউনাইটেড প্রোডাকশনের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল একটি ট্যালেন্ট-হান্ট প্রতিযোগিতার। গোটা দেশ থেকে দশ হাজারের ওপর প্রতিযোগী হাজির হয়েছিল সেখানে। প্রত্যেকের চোখে একটাই স্বপ্ন— অভিনেতা হওয়ার। সেই ভিড়ে হাজির হয়েছিলেন পাঞ্জাবের এক তরুণও। থিয়েটার করতে করতে অভিনয় শিল্পের প্রতি ভালোবাসা। তরুণটির লক্ষ্য, একদিন তিনি ভারতের সিনেজগতের সম্রাট হবেন। প্রতিযোগিতা শেষে দেখা গেল, সবাইকে টেক্কা দিয়ে তরুণটি সেরার জায়গা করে নিয়েছে। সেই থেকে জন্ম নিল এক রূপকথার। যার নাম রাজেশ খান্না…

বলিউড অনেক ব্যক্তিত্বের উত্থান-পতন দেখেছে। অনেকে এসেছেন, দেখেছেন, একটি-দুটি সিনেমায় উজাড় করে দিয়েছেন; তারপর হারিয়ে গেছেন। তবুও ‘মুম্বই মেরি জান’। কত তরুণ এখানে স্বপ্ন দেখতে আসে, কত মানুষ লোকাল ট্রেনের ভিড়ে হারিয়ে যান। কিন্তু রাজেশ খান্না? তাঁর রাস্তাটা যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। চুনীলাল খান্না ও লীলাবতী খান্নার দত্তক সন্তান হিসেবে জীবনের পথে হাঁটা। তখন তিনি কেবলই যতীন খান্না। ধীরে ধীরে সেই যতীন থেকে ‘দ্য রাজেশ খান্না’ হওয়ার গল্পই বলিউডের অন্যতম আখ্যানে পরিণত হয়।  

কথায় বলে, পরিশ্রম আর ভাগ্য— দুটো সঙ্গে থাকলে মানুষ জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারবে। রাজেশ খান্নার ক্ষেত্রে এই দুইয়ের ভূমিকা কি অস্বীকার করা যায়? ১৯৬৬ সালে প্রথম সিনেমা ‘আখরি খত’ পেয়ে গেল অস্কারের মনোনয়ন। প্রায় একইসঙ্গে মুক্তি পায় ‘রাজ’। ততদিনে যতীন খান্না বদলে গেছেন রাজেশ খান্না-য়। ভালো অভিনেতা, নায়ক হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন একটু একটু করে। পুরো ছবিটা বদলে গেল, যখন ১৯৬৯ সালে মুক্তি পেল ‘আরাধনা’। শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে রাজেশ খান্নার অভিনয়ে চমকে গেল আসমুদ্রহিমাচল। প্রথমে অবশ্য এই ছবিতে অভিনয় করতে চাননি রাজেশ খান্না। এটি নাকি নায়িকাকেন্দ্রিক ছবি; তাই করবেন না। পরিচালক শক্তি সামন্ত কোনোক্রমে রাজি করালেন। বাকিটা তো ইতিহাস! এখান থেকেই শুরু হল তাঁর ক্যারিশমা। জন্ম নিলেন ভারতের প্রথম ‘সুপারস্টার’… 

‘ইত্তেফাক’, ‘সফর’, ‘খামোশি’, ‘কাটি পাতাঙ্গ’, ‘আনন্দ’, ‘হাতি মেরে সাথী’— রাজেশ খান্না মানেই সুপারহিট সব সিনেমা। আর গান? কিশোর-রাজেশ জুটির সেইসব গানে তো আজও ভেসে যাই আমরা। ‘আনন্দ’-এর ডায়লগ কি আজও ভোলা যায়! ছোট্ট জায়গা থেকে উঠে এসে আজ তিনি বলিউডের সিংহাসনে। ঠিক যে স্বপ্নটি দেখেছিলেন। কিন্তু সেসব এত তাড়াতাড়ি হবে, কেউ ভাবতেও পারেননি। আগমন হওয়ার চার বছরের মধ্যে রাজেশ খান্না আকাশ ছুঁয়েছেন। সেইদিকে তাকালে ভয়ও লাগত আরেক অভিনেতা- অমিতাভ বচ্চনের। পরবর্তীকালে শর্মিলা ঠাকুরের মতো অভিনেত্রীরাও স্বীকার করেছেন, সেই সময় রাজেশ খান্নার জনপ্রিয়তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি কেউ। তিনি যেন একমেবাদ্বিতীয়ম… 

ঠিক কেমন ছিল রাজেশ খান্নার জনপ্রিয়তা? কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাট থেকে বাংলা— সমস্ত ভারতের নারী হৃদয়ে তুফান তুলেছিলেন তিনি। রাজেশের সাদা ফিয়াট গাড়িকে একবার ছোঁয়ার জন্য হাহাকার পড়ে যেত। এমনও হয়েছে, রাজেশ খান্না সেই গাড়ি চড়ে কোথাও এসেছেন। গাড়িটা একটু নিরালায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয় নায়ককে না পেয়ে, সেই গাড়ির ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়তেন মহিলারা। লিপস্টিক আর চুম্বন দাগে সাদা ফিয়াট লাল হয়ে যেত। শোনা যায়, অনেকেই রাজেশ খান্নাকে নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে পাঠাতেন! এমনকি তাঁর ছবিকে বিয়েও করতেন।  

এমনই ছিল আবহাওয়া। ২০১২ সালে দীর্ঘ অসুস্থতায় ভুগে যখন চিরকালের মতো চলে গেলেন রাজেশ খান্না, তখন বহু মহিলা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তাহলে কী এমন হয়েছিল যে, সেই স্টারডম থেকে পড়ে গেলেন একদিন? যে উল্কাগতিতে সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন, সেই গতিতেই যেন একদম একা হয়ে গেলেন। আশির দশক থেকেই রাজেশ খান্নার প্রভাব কমতে শুরু করেছিল। ততদিনে অমিতাভ বচ্চন নামের এক ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’-এর উত্থান দেখে ফেলেছে বলিউড। ধীরে ধীরে তিনিও কিংবদন্তি হয়ে উঠবেন। আর এই আবহেই আরও, আরও একা হয়ে গেলেন ‘কাকা’ রাজেশ খান্না। 

আরও পড়ুন
পুলিশের চোখে ধুলো দিতে সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন বিপ্লবী উধম সিং

তার ওপর ছিল একের পর এক ব্যর্থ প্রণয়। ডিম্পল কাপাডিয়ার সঙ্গে বিয়ে হলেও, সেই সম্পর্ক খুব মধুর ছিল না। একা রাতে আরও নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে বসে রইলেন রাজেশ খান্না। এত কালজয়ী সিনেমা দেওয়ার পরও, তিনি কক্ষচ্যুত নক্ষত্র। কিন্তু ইতিহাস তো তাঁকে অস্বীকার করতে পারবে না। বলিউডও ভুলতে পারবে না তাঁর প্রথম সুপারস্টারকে। কেনই বা ভুলবে? রাজেশ খান্নাই তো বলে গিয়েছিলেন ‘বাবুমশাই, জিন্দেগি লম্বি নহি, বড়ি হোনি চাহিয়ে’… 

তথ্যসূত্র-
১) ‘Rajesh Khanna Birth Anniversary: When Kaka's white Fiat car was covered with lipstick marks!’, Jagran
২) ‘Rajesh Khanna: The Superstar who could not handle success’, Vivek Kaul, First Post

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
একমাত্র ভারতীয় সিনেমা হিসেবে এ-বছর অস্কারে মনোনীত 'জালিকাট্টু'

More From Author See More