Cannes-এর দরজা ঠেলে: যে কথা বলা হল না

বিগত দুই সপ্তাহ জুড়ে ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসব নামক যে সৃজন-কাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম, তা যে-কোনো মানুষের জীবনের প্রতি দৃষ্টিকোণ পাল্টে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সিনেমা নিয়ে আমার বা আমাদের বন্ধুবান্ধবদের দুর্বলতা, ভালোবাসা এমনকি পড়াশোনা নিয়েও মাঝেমধ্যেই গর্ব হত আমার। কিন্তু কান চলচ্চিত্র উৎসব সেই স্বকীয়তার নার্সিসিস্ট বেলুনকে এক লহমায় উড়িয়ে আমায় অন্তর্দৃষ্টির সোঁদামাটির উঠোনে দাঁড় করিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, সিনেমা নিয়ে মানুষের উন্মাদনার বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাস। সে-ঢেউয়ে ডুবসাঁতার দিতে দিতেই সিনেমার তত্ত্ব, প্রক্রিয়া, মানব-সংযোগ পদ্ধতির নতুন নতুন দিশায় দীক্ষিত হয়েছি বললেও বিরাট ভুল হবে না। আসলে এই কর্মযজ্ঞের শুরুর ঝলকে প্রথমেই চোখে ধাঁধাঁ লাগে। বুঝতে সময় লাগে যে, টিভির পর্দায় দেখা লাল গালিচার উৎসবের থেকে কান-এর সত্যিকারের চলচ্চিত্রযাপন বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগৎ। সে জগতের সৃজন-উদযাপনের সঙ্গে টিভিতে দেখা লালাভ ঝলকের সত্যিই বিশেষ সম্পর্ক নেই।

কাজেই প্রশ্ন ওঠে রাজনীতির। আমি তাই বিশ্বখ্যাত কান ফিল্ম ফেস্টিভালের (Cannes Film Festival) অলিগলির অজানা গল্প খুঁজতে শুরু করি। কথা হয় এমন অনেক মানুষের সঙ্গে, যাঁদের ছাড়া এ-উৎসব চলচ্ছক্তিহীন। যেমন ধরা যাক, প্যালে দে ফেস্টিভালের তিনতলায় অর্থাৎ প্রেস অঞ্চলে অবস্থিত ইনফরমেশান ডেস্কে হাসিমুখের উজ্জ্বল মেয়ে ক্রিশ্চিয়ানার কথা। প্রথম দিনেই ক্রিশ্চিয়ানার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল বেশ। ওঁর কথায় মাঝেমধ্যেই ফেস্টিভাল কমিটির প্রতি অভিমানের ঝলক আমি আগেও লক্ষ করেছি। তবে উৎসবের শেষ দিন নিজের কথাগুলো চেপে না রেখে বলে ফেলেন, ‘আমার মনে হয় না আমি আর এই ফেস্টিভালে কাজ করব বলে।’ আমি একটু অবাক হই। আরেকটু বিশদে জানতে চাওয়ায় ক্রিশ্চিয়ানা জানান, রানস্টাড নামক এক কোম্পানি কমিটির হয়ে তাঁদের ফেস্টিভালের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করেছে। সমস্যা হল, যে কন্ট্রাক্টে তাঁরা এই স্বল্পকালীন কাজে যোগ দেন, সেই কন্ট্রাক্টের বেশিরভাগ কথাই কমিটি পালন করেনি। উপরন্তু ১৭ তারিখের অনলাইন সমস্যার জন্য অহেতুক তাঁকে নামকরা সাংবাদিকরা হেনস্থাও করেছেন। এমনকি দু-একজন অকথ্য ভাষায় গালাগাল করায়, কমিটিকে জানানোয় শুনতে হয়েছে, ‘দিস ইজ পার্ট অফ ইওর জব!’ প্রেস ক্যাফেয় আমাদের চাহিদামতো কফি জোগানোর দায়িত্বে থাকা নিকোলারও প্রায় একই বক্তব্য৷ জানালেন, ‘আমাদের সকাল চারটে থেকে রাত বারোটা অবধি কাজ করতে হচ্ছে। সাংবাদিকদের অনেকেই রাত অবধি এখানে কাজ করেন, তাঁদের কফির প্রয়োজন হয়। তাই আমাদেরও থেকে যেতে হয়। কন্ট্রাক্টে কিন্ত এ-সমস্ত লেখা ছিল না। আর আমরা এই বারোদিনের কাজের জন্য যে টাকাটা পাচ্ছি, এই কাজের তুলনায় তা কিছুই নয়।’

এ তো গেল উৎসবের অভ্যন্তরীণ পটচিত্রের কথা। আরেকটা জরুরি ব্যাপার, সমসাময়িক পৃথিবীর রাজনীতিতে এই ফেস্টিভালের অবস্থান। এ-ব্যাপারে প্রথম আলাপের দিনেই প্রায় ঘণ্টাখানেক আড্ডা হয় এবারের FIPRESCI জুরি কমিটির অন্যতম সদস্য বাংলাদেশের বিধান রেবিরোর সঙ্গে। উৎসবে আসার কথা জানাতেই কলকাতা তথা বঙ্গদেশের খ্যাতনামা সংস্কৃতি আলোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, বিধানবাবুর নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করার কথা জানিয়েছিলেন। নানা কাজে ব্যস্ত থাকায়, ফেস্টিভালের প্রায় শেষ লগ্নে এসে আলাপ। বিধানের FIPRESCI জুরি কমিটির সদস্য হিসাবে মনোনয়ন বাংলাভাষী হিসাবে অবশ্যই যথেষ্ট গর্বের কথা। 

যে বিষয়ে কথা হচ্ছিল, সে-কথায় ফেরা যাক। এবারের উৎসবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউক্রেনকে এক বিশেষ জায়গা দিয়েছে ফেস্টিভাল কমিটি। তার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম দিনের বিচিত্রানুষ্ঠানের শুরুতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কির বক্তব্য সরাসরি প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় দেখানো হয়। এখানেই শেষ নয়। টম ক্রুজকে আনিয়ে, তাঁর সম্পূর্ণ কমার্শিয়াল ফিল্মটির উদ্বোধনে ফরাসি বিমানবাহিনীর আকাশ-জোড়া রঙের খেলা যে কেবলই মনোরঞ্জন নয়, তা যে-কোনো সুস্থ মনের মানুষই বোঝেন। এমনই সব ব্যাপার নিয়েই কথা হতে হতে বিধান বলেন, ‘ভেবে দেখুন, আমরা কিন্তু রাশিয়ার দিকের বক্তব্য কিছু জানতেই পারছি না!’ বিধানের কথার সূত্রেই আমাদের মনে রাখতে হবে, রাশিয়াকে কিন্তু পুরোপুরি ব্রাত্য করেছে এবারের উৎসব কমিটি। 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: লেন্সবন্দি তারকারা

কাজেই, সিনেমার মক্কায়, চলচ্চিত্র উৎসবের ঝলকে শুরুর দিনে চোখে যে ঝিলমিল লাগে, ধীরে ধীরে তারই অলিগলিতে রাজনৈতিক প্রোপাগ্যান্ডা ও অমানববিক শ্রমিক নিপীড়নেরও গল্প দেখতে পাই আমরা। তা বলে কি প্রেম দেব না? অবশ্যই দেব। কিন্তু সে-প্রেম যেন ভালো-মন্দে মেশানো মানবিক প্রেম থেকে পূজা পর্যায়ের ঐশ্বরিক প্রেমে রূপান্তরিত না হয়, সে খেয়াল আমাদের রাখতে হবে। মিডিয়া হিসাবে, সাংবাদিক হিসাবে সে-কাজটুকুই আমরা করতে পারি। বছরের পর বছর ধরে লাল গালিচার গ্ল্যামার নামক যে সার্কাস টিভির পর্দায় কান ফিল্ম ফেস্টিভালের নামে চালানো হয়, তার থেকে বেরিয়ে এসে উৎসবের মানবিক মুখের দিকে খোলা মনে তাকানো প্রয়োজন। সত্যিকারের সিনেম্যাটিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ ‘ইন কম্পিটিশান ফিচার ফিল্ম’-গুলোর বাইরের বিভাগগুলিতেই মূলত দেখানো হয়। সে-খবর কজন মূলস্রোতের সাংবাদিক কভার করেন? 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ‘বয় ফ্রম হেভেন’ এবং এক ন্যারেটিভের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার গল্প

‘ইন কম্পিটিশান ফিচার ফিল্ম’ বিভাগের জুরি নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে পৃথিবীর সর্বত্র। সে-পদ্ধতি কতটা মেধা নির্ভর, আর কতটাই-বা ব্যবসায়িক, সে-প্রশ্ন থেকেই যায়। বিগত দুই সপ্তাহের ক্লান্তিকর ছোটাছুটির মধ্যে এই কাজটুকুই করার চেষ্টা চালিয়ে গেছি। মূল কথা একটাই, সত্যি গল্প, অল্প-জানা গল্পগুলো বেরিয়ে আসুক। পূর্ব-পশ্চিম ইগোর লড়াইয়ে গুঁড়িয়ে যাওয়া ইউক্রেন, আফগানিস্তানের মতো দেশের মানবিক জগৎ আবার পায়ের তলার মাটি ফিরে পাক। ক্রিশ্চিয়ানা, নিকোলারাই হয়ে উঠুক পৃথিবীজোড়া আপামর শ্রমিকের মুখ। 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: মুখোমুখি লাল গালিচার চিত্রকর

বন্দুক নয়; কলম, সিনেমা আর ক্যামেরার লেন্সই হয়ে উঠুক মানবিক অঙ্গীকার ও বিপ্লবের উৎস!

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More