ল্যুভার থেকে চুরি মোনালিসা; শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ‘প্রবঞ্চক’ এক রংমিস্ত্রি?

তেইশে আগস্ট, ১৯১১। ক্যালেন্ডারে বলছে দিনটা বুধবার। প্যারী শহর অন্যান্য আর পাঁচটা দিনের মতোই সেদিনও আর একটা কর্মমুখর দিনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। প্যারীর জনসাধারণ কি জানত, আগামী কয়েক মিনিটের মধ্যে এক ভয়ানক দুসংবাদ অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য! অন্যান্য দিনের মতোই খবরের কাগজ পৌঁছে গেছে প্যারীর প্রায় প্রতিটি মানুষের দরজায়। আর সংবাদপত্রের পাতা ওল্টাতেই চমকে উঠলেন সকলে। হেডলাইন – ‘লা জ্যাকোন্ডা অপহৃতা!’

এও কি সম্ভব? প্যারীর উপকণ্ঠে অবস্থিত ল্যুভারের নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে তো একটা সূচ গলাও অসম্ভব। আর সেই নিরাপত্তা বেষ্টনীর গালে বেমালুম থাপ্পড় কষিয়ে উধাও মোনালিসা? হ্যাঁ সেদিন এই অসম্ভব কাজটিও সম্ভব হয়েছিল, নেপথ্যে ছিলেন কারা? এক সাধারণ রংমিস্ত্রি আর এক ধনকুবের। 

বস্তুতপক্ষে এই গল্পটার শুরু হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার বুয়েনস এয়ার্স থেকে। এখানেই জন্ম ওয়ালফিয়েনোর। জন্ম থেকেই ধমনীতে প্রবাহিত হত জমিদারি রক্ত। আরে হবে নাই বা কেন? তার বাবা ছিলেন মস্ত জমিদার। ফলে জমিদারি ঠাঁটবাট ছিল আজন্মকাল থেকেই। অন্যদিকে পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন আবার একেবারেই না পসন্দ ওয়ালফিয়েনোর। কিন্তু জমিদারি চাল-চলন যে বজায় রাখতে হবে আর তার জন্য চাই লাখ লাখ ডলার। সুতরাং শুরু হল ফন্দিফিকির, যাতে সাপও মরে আবার লাঠিও না ভাঙে। অর্থ্যাৎ দু-ডলার হাতে আসবে কিন্তু বিনা পরিশ্রমে। কিছুদিনের মধ্যেই ওয়ালফিয়েনো বুয়েনস এয়ার্স অঞ্চলেই শুরু করল একটি ওয়ার্কশপ। যাদের কাজ হাজার হাজার বছর আগের শিল্পসম্ভারের নকল তৈরি করা। 

যদিও এই ব্যবসা বেশিদিন টেকেনি, কিছুদিনের মধ্যেই বমাল সমেত পাততাড়ি গুটোতে হল তাকে। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। একবার বিনা পরিশ্রমে কাঁচা টাকার গন্ধ যে পেয়েছে সে কি আর এত সহজে বশ মানে? সুতরাং ওয়ালফিয়েনোর এবার নজর পড়ল চিত্রসম্ভারের উপর। ওয়েলফিয়েনো খোঁজ করতে লাগল একজন সঙ্গীর। কারণ যে সমস্ত বিখ্যাত ছবি চুরি করা হবে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন পড়বে তার নকল বানানোর। না বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে, জুটেও গিয়েছিল এক সঙ্গী। নাম তার শাদ্র। প্রথমে ছোটখাটো ছবি চুরি দিয়ে হাতেখড়ি। কিন্তু ওই যে অল্পেতে যে স্বাদ মেটে না। ছোটখাটো ছবি চুরি বেশিদিন সহ্য হল না ওয়েলফিনেরোর। সে ঠিক করল এবার একটা বড়ো দাঁও মারতে হবে। মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভাণ্ডার। 

সেইমতো সমস্ত পরিকল্পনা শোনানো হল দীর্ঘদিনের অপরাধের ছায়াসঙ্গী শাদ্রকে। কিন্তু বিধি বাম। শাদ্র এবার সম্পূর্ণ বেঁকে বসল। না বেশি পারিশ্রমিকের লোভে নয়, তার বেঁকে বসার কারণ ছিল ওয়ালফিয়েনো এবার প্রেমে পড়েছিল স্বয়ং মোনালিসার। অর্থাৎ ওয়ালফিয়েনো চাইছিল, যেন তেন প্রকারে ল্যুভার নামক বন্দিশালা থেকে সেই ছবিকে উদ্ধার করে আনতে। আর এত বড়ো অপরাধের ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না শাদ্র। তার ভয় ছিল ল্যুভার চক্রব্যূহ ভেদ করা অসম্ভব, আর তা করতে গিয়ে ওয়েলফিয়েনো যদি প্যারী পুলিশের জালে ধরা পড়ে তাহলে তার সঙ্গে শাদ্রর দ্বীপান্তর নিশ্চিত।  

এবার আসা যাক ভিনসেঞ্জো পেরুগিয়ার প্রসঙ্গে। কে এই পেরুগিয়া? কী তার পরিচয়? না পেরুগিয়া বিখ্যাত কোনো শিল্পবোদ্ধা নয়, সে ছিল গোবিয়ার কোম্পানির একজন সাধারণ কর্মচারী, তথা রংমিস্ত্রি। আবার সেই ছিল মোনালিসা অপহরণ কাণ্ডের ট্র্যাজিক নায়ক। হ্যাঁ ট্র্যাজিকই বটে, কারণ গল্পের শেষ অংশটা একেবারেই নায়কোচিত নয়, অন্তত পেরুগিয়ার ক্ষেত্রে। রংমিস্ত্রি হলে কি হবে পেরুগিয়া ছিল অসম্ভব উচ্চাকাঙ্খী। ফলে ওয়ালফিয়েনোর সঙ্গে যখন তার মোলাকাত হল তখন পেরুগিয়াকে কিনে নিতে বেশি সময় লাগল না ওয়ালফিয়েনোর। একটা নতুন ফোর্ড গাড়ির প্রস্তাব বোকা রং মিস্ত্রি পেরুগিয়ার জন্য নিতান্ত কম নয়। 

আরও পড়ুন
মোনালিসার হাসি কীভাবে এঁকেছিলেন ভিঞ্চি? পাঁচ শতক পরে সমাধান রহস্যের

১৯১১ সালের বিশে আগস্ট। সময়টা বেলা আড়াইটে। লুভ্যার মিউজিয়ামে প্রবেশ করল তিন মূর্তি - পেরুগিয়া মিকেল এবং লান্সিলোত্তি। ল্যুভারের অন্দরমহলে অবস্থিত একটি গুদামঘরে সারাদিন আত্মগোপন করে থাকল এই তিনজন। পরেরদিন সোমবার চুরি গেল বিশ্ব ললিতকলার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ - লা জ্যাকোন্ডা। 

এরপরের নাটকটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইতালিতে। যদিও তার আগেই পেরুগিয়ার স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে। মোনালিসার ছবি চুরির পর যে অখ্যাত রংমিস্ত্রি ভেবেছিল বাকি জীবনটা কাটবে নিশ্চিন্তে, সে পুনর্বার পথে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানেই বারংবার প্রবঞ্চক ওয়ালফিয়েনোর স্বমূর্তি প্রকাশ হয়ে পড়ে। পেরুগিয়া যেদিন ছবিটি চুরি করেছিল তার আগেই ওয়ালফিয়েনো শাদ্রর সহযোগিতায় প্রায় ছটি নকল মোনালিসা এঁকে ফেলে। সেই নকল মোনালিসা বিক্রি করা হয় আসল বলে। অর্থ্যাৎ প্ল্যানটি পরিষ্কার। একদিকে খদ্দেররা দেখল লুভ্যার থেকে অপহৃতা মোনালিসা, অন্যদিকে শাদ্র যে নকল মোনালিসাগুলি পয়দা করেছিল সেগুলোকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে চালানো হল আসল মোনালিসা নামে। অন্যদিকে পেরুগিয়ার কাছেই থেকে গেল আসল মোনালিসা। যাকে সে এতদিন তুরুপের তাস ভাবছিল সেই লা জ্যাকোন্ডাকেই কোথাও বিক্রি করতে পারল না পুলিশের ভয়ে। 

এরপর চলে যাওয়া যাক ইতালির একটি হোটেলে। ততদিনে মোনালিসাকে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে প্যারী থেকে ইতালি এসেছে পেরুগিয়া। একইসঙ্গে তার চলছে প্রবল অর্থসংকট। না ওয়েলফিয়েনো আর ফিরে আসেনি পেরুগিয়ার কাছে। আসল মোনালিসা বলে সে যে ছটি ছবিকে বিভিন্ন জায়গায় বেচেছিল সেই টাকা থেকেই তার জীবন কেটে যাচ্ছিল স্বচ্ছন্দে। অন্যদিকে হতভাগ্য পেরুগিয়া ঠিক করল ইতালির শ্রেষ্ঠ সম্পদ ইতালিকেই ফিরিয়ে দেবে। অশিক্ষিত পেরুগিয়া ভাবতো মোনালিসাকে নেপোলিয়ন অপহরণ করেছে ইতালি থেকে। যা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। ইতালি আসার আগেই পেরুগিয়া চিঠি দিয়েছিল শিল্প বিশারদ গেরিকে। মোনালিসার খবর পেয়ে উৎসাহিত গেরিও। কিন্তু হিসেবে একটু ভুল করেছিল পেরুগিয়া। গেরি সেদিন ইতালির হোটেলে হাজির হলেন সাদা পোশাকের পুলিশ নিয়ে। 

আরও পড়ুন
অ্যানাটমির বইয়ের থেকেও নিখুঁত দা ভিঞ্চির আঁকা হৃৎপিণ্ড, জানাচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা

এরপরের ঘটনা যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত - পুলিশের জালে ধরা পড়ল পেরুগিয়া। হ্যাঁ হতভাগ্য সেই রংমিস্ত্রি। যে ভেবেছিল তার দেশ ইতালিকেই ফিরিয়ে দেবে ইতালির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। জাতীয়তাবাদ যেনো পেরুগিয়ার জন্য যূপকাষ্ঠে পরিণত হল। অবশ্য পেরুগিয়াকে ততদিনে নায়কের সম্মান দিয়ে ফেলেছে ইতালিয় জনসাধারণ। বিচারক সর্বনিম্ন বিধান দিলেন পেরুগিয়াকে। সাত মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড। ১৯১৪ সালের ২৯ জুলাই মুক্তি পেলো পেরুগিয়া, এ যুগের অন্যতম প্রবঞ্চক। 

কিন্তু শুধুই কি প্রবঞ্চক? না তা হয়তো নয়। প্রবঞ্চকের তকমা যদি পেতেই হয় তাহলে তো তা পাওয়া উচিত ওয়ালফিয়েনোর। যে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছিল পেরুগিয়াকে। আর পেরুগিয়া? দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শেষপর্যন্ত এক প্রবঞ্চক এক চোর হিসেবেই অতিবাহিত হয় তার বাকি জীবন। 

না, বিচারের সময় পেরুগিয়া ওয়ালফিয়েনোর নাম ভুলেও মুখে আনেনি। তার হয়তো ভয় ছিল ইতালির যেসব মানুষ তাকে নায়কের সম্মান দিয়েছে ওয়ালফিয়েনোর ঘটনা জানলে তারাই তাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলবে। দু বছর চার মাস চোদ্দো দিন পর উদ্ধার হল মোনালিসা। আশ্চর্যের কথা, তার মুখে তখনও সেই রহস্যময় হাসি।  যেন বলতে চাই - দেখলে কেমন খেল দেখালাম!  এভাবেই এক প্রবঞ্চকের অন্তরালে থেকে যাওয়া অথবা এক রংমিস্ত্রির নিছক দেশপ্রেমের কোপে অপরাধী প্রমাণ হয়ে যাওয়ার মূলে ছিল সেই সদাহাস্যময় নারী - লা জ্যাকোন্ডা ওরফে মোনালিসা। 

আরও পড়ুন
জন্মদিনেই চুরি, মিউজিয়াম থেকে উধাও ভ্যান গঘের আঁকা ছবি

তথ্যসূত্র -
প্রবঞ্চক, নারায়ণ সান্যাল
দ্য ম্যান হু স্টোল দ্য মোনালিসা, মারিয়া পেরেজ
দ্য ডে দে স্টোল দ্য মোনালিসা, স্যামুয়ের রাইট

Powered by Froala Editor

More From Author See More