সামান্য কথাই বদলাতে পারে জীবন; আত্মহত্যা রুখতে লড়াই বাস্তবের ‘হেমলক সোসাইটি’র

‘হেমলক সোসাইটি’র কথা মনে আছে? বছর আটেক আগের এই সিনেমার মূল চরিত্র আনন্দ করের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। বিভিন্ন মানুষকে আত্মহত্যা থেকে বিরত করে আত্মহত্যার ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যেতেন তিনি। তারপর সেখানের শিক্ষকরা বিভিন্ন কোর্সে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তুলে ধরতেন আত্মহত্যার ভয়াবহতা, নির্মমতা। আত্মহত্যার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ব্যানার সামনে রেখে মানুষকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।

কিছুদিন আগেই ভারতে প্রকাশিত হয়েছে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান। সরকারি রিপোর্টে দেখা গেছে ভারতে আত্মহত্যার ঘটনা আগের বছরের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে হেমলক সোসাইটির মতো কোনো সংস্থার অস্তিত্ব অনেক মানুষকেই জীবনের লড়াইয়ে ফিরিয়ে আনতে পারত, এমন ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যিই কি আছে এমন সংস্থার অস্তিত্ব? 

‘How to commit suicide’ কি-ওয়ার্ড লিখে গুগলে সার্চ করলেই বেরিয়ে আসবে একটি হেল্পলাইন নম্বর। ‘AASRA’ বলে একটি সংস্থার। হ্যাঁ, আসরা বাস্তবের হেমলক সোসাইটি। সেখানে আত্মহত্যা করতে যাওয়া কেউ ফোন করলেই তাঁদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ স্বেচ্ছাসেবীরা। খুঁটিয়ে বের করে আনেন তাঁদের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা। তাঁদের থেকে বার করে আনেন মনের ভেতর জমে থাকা দুঃখ, অবসাদ, কখনো কখনো ক্ষোভ-ও। ‘আসরা’-র সদস্যরা কথোপকথনের মাধ্যমে সাহস জোগান তাঁদের, দেন মানসিক আশ্বাসবাণী। প্রতিদিন উপকৃত হন প্রায় ২৫০-র কাছাকাছি মানুষ। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শুরু করে বাইরের কিছু দেশ থেকেও ফোন আসে 'আসরা'-র কাছে।

“১৯৯৭ সালে ভারতে আত্মহত্যার ঘটনা আস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। যা আমাদের যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল আমাদের বন্ধুদলের মধ্যে। তখনই আমাদের এই গ্রুপটা থেকে উঠে এসেছিল এই পরিকল্পনা, যদি মানুষের অসহায়তার পাশে দাঁড়ানো যায় কোনোভাবে। তারপর ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু হয়েছিল আসরা’র পথ চলা।” প্রহরকে বলছিলেন আসরা’র ডিরেক্টর জনসন থমাস। ১৯৯৭ সালেই প্রায় এক লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করেছিলেন দেশজুড়ে। রাজ্যের নিরিখে তাঁর সবথেকে বেশি আঁচ পড়েছিল মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, অন্ধ্র এবং মধ্যপ্রদেশে। বহু কৃষক এবং ছাত্রেরা সে সময় বেছে নিচ্ছিলেন আত্মহত্যার পথ। তবে লড়াইটা সহজ ছিল না আসরা’র। 

থমাস বলছিলেন, “তখনও ‘আত্মহত্যা’ ভারতীয় আইনবিধি অনুযায়ী একটা বড় ক্রাইম। ফলে কাউকে সাহায্য করতে যাওয়া হল এবং ধরা যাক সে আত্মহত্যা করে ফেলল তার আগেই। সেক্ষেত্রে উলটে বিপদের মুখে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। ‘অ্যাসিস্ট অফ সুইসাইড’-এর মামলা আমাদের ওপরেই এসে পড়ার সম্ভাবনা ছিল একটা। যেহেতু আমরা স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কাজ করা শুরু করেছিলাম। তাই তাঁদের নিরাপত্তাও একটা বড়ো বিষয় ছিল আমাদের কাছে। ফলে শেষ অবধি সুইসাইড প্রিভেনশনের একটি ব্রিটিশ মডেল আমরা ফলো করি। ২৪X৭ হেল্পলাইন খোলা হয়। এবং সেখানে প্রশিক্ষিত ভলেন্টিয়াররা সারাদিন উপস্থিত থাকেন যে কোনো ধরণের মানসিক সাহায্যের জন্য।”

আরও পড়ুন
ইউরোপে মোট আত্মহত্যার ১৩ শতাংশই পরিবেশ দূষণের প্রভাবে, জানাচ্ছে সমীক্ষা

প্রথমে মুম্বাইতে এই সংস্থা গড়ে উঠলেও ধীরে ধীরে পরিধি বেড়েছে এই সংস্থার। বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন শহরের জন্য এখন রয়েছে আসরার আলাদা আলাদা হেল্পলাইন নম্বর। কারণ একজন আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনার মূলমন্ত্রই হচ্ছে যোগাযোগ। সেক্ষেত্রে ভাষা একটি বড়ো চাবিকাঠি। তবে আজও সেইভাবে পুলিশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই আসরা’র। মানুষকে মানসিকভাবে ভরসা দেওয়ার মাধ্যমেই আত্মহত্যাকে কমিয়ে আনার বিশ্বাসী তারা। “আত্মহত্যা শুধুমাত্র কয়েকটা মুহূর্তের ভাবনা। এমন কিন্তু নয় যে কোনো ব্যক্তি কয়েকদিন ধরেই ভাবছে আত্মহত্যা করার ব্যাপারে। কোনো একটা বিন্দুতে গিয়ে তাঁর অবসাদের বিস্ফোরণ ঘটে। সেই মুহূর্তে যদি সে সঠিক কাউন্সিলিং পায়, নিজের কথাগুলো প্রকাশ করতে পারে, তাহলেই বুঝতে পারে তাঁর ভুলের কথা”, মত থমাসের। তবে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির পরিবারের কেউ সে বিষয়ে জানালে তাঁদেরকে আসরার আধিকারিকরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য রাজি করান। অন্যদিকে সাহায্যপ্রার্থীর সমস্তরকম তথ্যই গোপন রাখে আসরা।

মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমেই আত্মহত্যার প্রবণতাকে অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু এই বিষয়ে প্রশাসনের ভূমিকা আশঙ্কাজনক। গ্রামাঞ্চল তো দূরের কথা অনেক শহরেও মানসিক রোগের জন্য বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে দেশে। ফলে সেই জায়গাটায় বড়-সড় ঘাটতি থেকেই গেছে। সেই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আসরা। বিভিন্ন শহরের স্কুল, কলেজ এমনকি পুলিশ-ক্যাম্পেও আসরা আয়োজন করে ওয়ার্কশপের। সচেতন করতে উদ্যোগ নেয় মানুষকে। পাশাপাশি দেশে বেশ কয়েকটি ম্যারাথনেরও আয়োজন করেছে এই সুইসাইড প্রিভেনশন সংস্থা।

সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে এনসিআরবি’র আত্মহত্যার রিপোর্ট। সেখান থেকেই উঠে আসছে শিক্ষিতদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা অনেকটাই কম। কিন্তু জনসনবাবু এর একেবারে উল্টোদিকটাই তুলে ধরলেন। জানালেন শিক্ষাই যথেষ্ট নয় আত্মহত্যার প্রতিরোধে। যদি কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে জীবনযাপনের পাঠক্রম না শেখানো হয়, তবে শিক্ষা কোনো প্রভাব ফেলবে না আত্মহত্যায়। পাঠ্যসূচির মধ্যে যাপনের প্রশিক্ষণ এবং মানসিক অবসাদের বিষয়েও পড়ানো আবশ্যিক করা উচিত সরকারের। এমনটাই মনে করছেন তিনি। 

আরও পড়ুন
‘আত্মহত্যা মহাপাপ’, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার যে নিদান বারবার দিয়েছে ধর্মগ্রন্থগুলি

অন্যদিকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাই বরং অনেকক্ষেত্রে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আত্মহত্যার। কোভিড পরিস্থিতি সেই সম্ভাবনাকেই আরও উসকে দিচ্ছে। অর্থনীতিকে সারিয়ে তুললেই আত্মহত্যার পরিমাণ অনেকটাই কমানো সম্ভব। তার জন্য দরকার কর্ম-সংস্থানের। যেখানে সরকারের ভূমিকা সেক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে। “নিম্নবিত্তদের মধ্যে সহনশীলতা অনেক বেশি থাকে। ফলে চরম আর্থিক সংকটকেও মানিয়ে নেন তাঁরা। কিন্তু সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। এই শ্রেণীর মধ্যেই আত্মহত্যার পরিমাণ বেশি”, বলছিলেন থমাস।

আত্মহত্যার বাস্তব পরিসংখ্যানও সরকারি পরিসংখ্যানের থেকে অনেকটাই আলাদা। এনসিআরবি’র রিপোর্টে লেখা, ভারতে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছেন এই বছর। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা বেশ খানিকটা বেশিই। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যাকে পুলিশের খাতায় দেখানো হয় অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসাবে কিংবা দুর্ঘটনা হিসাবে। আবার আত্মহত্যার কারণে পুলিশি মামলায় জড়াতে না চেয়ে চিকিৎসকদের থেকে সাধারণ ডেথ সার্টিফিকেট করিয়ে নেন অনেক পরিবার। ফলে সেসব ঘটনাও প্রকাশ্যে আসে না। যথেষ্ট কম পুলিশি তৎপরতাও। শুধুমাত্র বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের আত্মহত্যাতেই তদন্ত চালায় পুলিশ। অন্যান্যক্ষেত্রেও সমান গুরুত্ব দেওয়া মতো প্রশাসনিক পরিকাঠামো এখনও গড়ে তুলতে অপারগ প্রশাসন।

আরও পড়ুন
মহিলাদের থেকে বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ পুরুষেরা; মানসিক দুর্বলতা নাকি অন্য সংকট?

পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রতিরোধে সরকারের হেল্পলাইনের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে পড়বার মতো। অনেকটাই তা যেন তথ্য সংগ্রহের কাজ করে। অটো-জেনারেটেড ভয়েসের মাধ্যমে সাহায্যপ্রার্থীকে অন্য কোনো সংস্থার নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয় সেখানে। তাতে একজন আত্মহত্যাকারীর আদৌ কোনো সমস্যার সমাধান হয় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এছাড়া মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র গঠনে একেবারেই গা-ছাড়া মনোভাব সরকারের, তা বলাইবাহুল্য। তবে ডিজিটালের যুগে বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসকদের অন্তত এই বিষয়ে কাজে লাগানো যায় না কি? সরকারের এই নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন জনসন থমাস। “আত্মহত্যা এখন দেশের অন্যতম একটি বড় সমস্যা। প্রতি বছরই এই সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অপেক্ষা করা, নিজের ধৈর্য ধরে রাখাই শেষ কথা এই মুহূর্তে। কিন্তু আমাদের আশ্বাসবাণীতে তো কোনো ব্যক্তির সমস্যা মিটে যাবে না। তাঁর কাছে পৌঁছতে গেলে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। একমাত্র সরকার হস্তক্ষেপ করলেই এই সমস্যার উন্নতি হতে পারে খানিকটা। একেবারেই যে মুছে যাবে তা নয়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাটুকু করতে হবে প্রশাসনকেই।”

এসবের পরেও নিজেরা সাধ্য মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আসরা’র কর্মীরা। সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন মানুষের মধ্যে। তবে এই সমস্যার শেষ কোথায়, তা জানা নেই কারোরই...

Powered by Froala Editor

More From Author See More