মৃত্যুর জন্য আকুতি বনাম ‘মাই ডেথ মাই চয়েস’ – ভারতে স্বেচ্ছামৃত্যুর ‘অধিকার’ ঠিক কেমন?

১৯৯৮ সালে জিয়ান কাউর মামলায় আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, জীবনের উপর অধিকার মানেই মৃত্যুর উপর অধিকার নয়। তাই পাঞ্জাবের সেই দম্পতিকে আত্মহত্যার চেষ্টার অপরাধে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যেক স্বেচ্ছামৃত্যুই তো আত্মহত্যা নয়। সেই প্রশ্নটাই জলজ্যান্তভাবে সামনে এল অরুণা শানবাগ মামলায়। পেশায় নার্স অরুণা একদল বিকৃত মানসিকতার পুরুষের যৌন লিপ্সার শিকার হন ১৯৭৩ সালে। তারপর ৭৩ বছর পেরিয়ে ২০১০ সালে তাঁর মৃত্যুর আবেদন জমা পড়ে সুপ্রিম কোর্টে। আর এই দীর্ঘ সময় ধরে ভেজিটেটিভ স্টেটে থেকেছেন অরুণা। হ্যাঁ, চিকিৎসকরা নিশ্চিত জানতেন তাঁর আর সুস্থ জীবনে ফেরার কোনো উপায় নেই। কিন্তু ওই যে, মৃত্যুর অধিকার নেই মানুষের। সেই অধিকার আছে শুধু ভাগ্যের।

অরুণা শানবাগ মামলায় কিন্তু হোঁচট খেল আমাদের এতদিনের চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধও। বাইরে প্রকাশ করার ক্ষমতা না থাকলেও ভিতরে ভিতরে কতটা যন্ত্রণা সহ্য করে চলেছিলেন অরুণা, সেটা আন্দাজ করা কঠিন নয়। এমনকি আদালতকেও অবশেষে স্বীকার করে নিতে হল, এমন পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছামৃত্যু আইনসঙ্গত হতে পারে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে সেই ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার দিতে হবে। কিন্তু তার নানা খুঁটিনাটি স্থির করার জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করতে হবে।

না, স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার পেলেন না অরুণা। কারণ সেই বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্ত স্থির হতে হতে বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছিল। এর মধ্যে ৪২ বছরের যুদ্ধ শেষ করে ২০১৫ সালেই সম্পূর্ণ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন অরুণা। আর স্বেচ্ছামৃত্যুর আইন প্রস্তুত হতে হতে ক্যালেন্ডারের পাতা এসে থামল ২০১৮ সালে।

কী বলছে ভারতে স্বেচ্ছামৃত্যুর আইন? জানার আগে একটু বুঝে নেওয়া যাক স্বেচ্ছামৃত্যু বিষয়টি কী? স্বেচ্ছামৃত্যু মানে আত্মহত্যা নয়। যে বিশেষ অবস্থায় পৌঁছে মানুষের বেঁচে থাকাটাই যন্ত্রণাময় হয়ে দাঁড়ায়, সেই অবস্থা থেকে মুক্তির নামই স্বেচ্ছামৃত্যু। কিন্তু কী সেই অবস্থা? এটা কিন্তু অনেকটাই দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর একটি প্রশ্ন। কারণ কারোর মনে হতে পারে যে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বেঁচে থাকাটাই যন্ত্রণাময়। অথবা অবসাদকেও এর মধ্যে ধরে নিতে পারেন। তাহলে কিন্তু বৃহত্তর অর্থে স্বেচ্ছামৃত্যু আর আত্মহত্যার মধ্যে কোনো পার্থক্যই থাকে না। কিন্তু এই সমস্ত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় আছে। অন্তত একটা সম্ভাবনা আছে। এখানে মৃত্যুর অর্থ একটি সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেওয়া। কিন্তু অনেক মানুষের শারীরিক অবস্থাই এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছে যায়, যেখান থেকে আর ফেরার উপায় থাকে না। চিকিৎসকরাও জানেন সেটা। কিন্তু তার পরেও কৃত্রিম ব্যবস্থাপনায় কোনোক্রমে হৃদযন্ত্রকে চালু রাখা হয়। সেই জীবন্মৃত মানুষদের জন্যই স্বেচ্ছামৃত্যু।

ভারতে ২০১৮ সালে পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু আইনসঙ্গত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটবে তিনি নিজে এক্ষেত্রে কোনো ধরনের মত রাখতে পারবেন না। বস্তুত মতামত রাখার মতো অবস্থায় যদি তিনি থাকেন, তবে স্বেচ্ছামৃত্যু আইনসঙ্গত হবেও না। একমাত্র কোমা বা ভেজিটেটিভ পর্যায়ের কোনো রোগীর আত্মীয় আবেদন জানালে বিশেষ মেডিক্যাল বোর্ড এবং রাজ্য সরকারের সুপারিশ অনুযায়ী হাই-কোর্টের অনুমতি নিয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটানো যেতে পারে। এই মৃত্যুও হবে কোনো অভ্যাসরত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানেই।

তবে একটি আইনে যে এত বড়ো একটা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, তা আগেও বোঝা গিয়েছিল। বিশেষ করে এর সঙ্গে যেহেতু জড়িয়ে আছে বৃহৎ অর্থে সামাজিক এবং নৈতিক প্রশ্নও। জীবন্মৃত অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির জন্যই দেওয়া হয় এই ধরনের মৃত্যু। কিন্তু কার নিষ্কৃতি? শুধুই কি রোগীর? আর তাঁর সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষদের নয়? চোখের সামনে একটা জীবিত মানুষকে মরার মতো শুয়ে থাকতে দেখাও কি যন্ত্রণার নয়? প্রশ্ন উঠবে। প্রশ্ন থাকবে। আর আদালতের বক্তব্য, এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে চিরাচরিত ধর্ম আর সংস্কৃতির মধ্যে মিশে থাকা নীতিকথার মধ্যেই।

আরও পড়ুন
মহিলাদের থেকে বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ পুরুষেরা; মানসিক দুর্বলতা নাকি অন্য সংকট?

কিন্তু সেখানেও কোনোরকমের ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পেরেছেন কি নীতিবাগীশরা? দেখা যাচ্ছে হিন্দু সংস্কৃতিতে আত্মহত্যাকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হলেও নির্বানের পথ খোলা আছে। এমনকি যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর থেকে সেই রাস্তাকে বেছে নেওয়াই ভালো, এমন সংকেতও বহু জায়গায় পাওয়া যায়। আবার ভারতেই এমন অনেক ধর্ম-সংস্কৃতি রয়েছে যেখানে আত্মহত্যাকেই রীতিমতো মহানুভবতা দান করা হয়েছে। সেইসব সংস্কৃতির মধ্যেই এখনও বেড়ে ওঠেন অনেকে। আজকের ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যার প্রবণতার পিছনে যে সেইসব গল্পকথার কোনো দায় নেই, এমন কথাও কি বলা যায়?

তবে পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মেই স্বেচ্ছামৃত্যুকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। কিন্তু তার পরেও বলতে হয়, যুক্তির পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আর বিষয়টিকে ততটা অন্যায় দৃষ্টিতে দেখা চলে না। তাই হয়তো সমস্ত দেশেই চিন্তা-ভাবনা বদলাচ্ছে। সুইৎজারল্যাণ্ড, নেদারল্যাণ্ড, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, কানাডা, কলম্বিয়া, অস্ট্রেলিয়া – ভারত ছাড়া এই ৬টি দেশে স্বেচ্ছামৃত্যু স্বীকৃত। এর মধ্যে সুইৎজারল্যান্ডের আইন রীতিমতো উদার। কিন্তু আবার নেদারল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার আইন অনুসারে নির্দিষ্ট বয়সের আগে এই অধিকার পাওয়া যায় না। আমেরিকাতেও বিভিন্ন স্টেটে বিভিন্ন আইন আছে। ফ্রান্সে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার দেওয়া না হলেও বিশেষ পরিস্থিতিতে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত মাদকের প্রভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখার নিয়ম আছে। তবে এর মধ্যে সুইৎজারল্যান্ডের কথাই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তার কারণ পরিসংখ্যানের হিসাবে সেখানে মোট মৃত্যুর ১.৫ শতাংশই স্বেচ্ছামৃত্যু।

সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা রীতিমতো অসুখের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের নিজের ইচ্ছায় মৃত্যুর অর্থই আত্মহত্যা নয়। কিন্তু কীভাবে দেখব স্বেচ্ছামৃত্যুকে? হাজার বছরের পুরোন ধর্মপুস্তকের নির্দেশের মধ্যে? নাকি আজকের বৈজ্ঞানিক মানসিকতার মধ্যেই করব সুলুকসন্ধান? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আমাদেরই।

আরও পড়ুন
আত্মহত্যা করেননি ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ; হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে!

Powered by Froala Editor

More From Author See More