মহিলাদের থেকে বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ পুরুষেরা; মানসিক দুর্বলতা নাকি অন্য সংকট?

বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে তোলপাড় তুলেছিল আত্মহত্যার প্রসঙ্গ। খুন নাকি আত্মহত্যা, সেই নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা চলার মধ্যেই চলে এল বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ বিশ্বব্যাপী এই দিনটিকে ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। মূলত নিজেকে শেষ করে দেওয়ার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে সচেতনতা তৈরি করার লক্ষেই এই উদ্যোগ। কিন্তু তারপর থেকে দেড় দশকের বেশি সময় কেটে গেলেও ঠিক কতটা পরিবর্তন এসেছে পরিস্থিতিতে? পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলে কিন্তু আশান্বিত হওয়ার বিশেষ কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে যে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও নিম্নআয়ের কোনও দেশেই আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য নির্দিষ্ট কোনও কৌশল বা কর্মপন্থা ঠিক করা হয়নি।

রোজকার সংবাদপত্র অথবা খবরের চ্যানেলের দিকে তাকালেই পরিষ্কার একটি আভাস পাওয়া যায় বিষয়টির। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন বয়সের কোনও না কোনও আত্মহত্যার খবর কেমন একটা যেন গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদেরও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তের পেছনে অনেক সময়ই থাকে খুব সামান্য কিছু কারণ। বিশেষ করে এই আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে দেশের তরুণ ও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে সবথেকে বেশি দেখা যায় আত্মহত্যার প্রবণতা। ২০১৮ সালে সারাদেশে ১০ হাজারেরও বেশি ছাত্রের আত্মহত্যার খবর সামনে এসেছিল। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে সংখ্যাটা ১০ হাজারের গণ্ডি না ছুঁলেও ঘোরাফেরা করেছিল তার আশেপাশেই। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে প্রতি ঘণ্টায় আত্মহত্যা করেন একজন ছাত্র। প্রতিদিনে গড়ে ২৮ জন ছাত্রের আত্মহত্যা নথিভুক্ত হয় দেশে। সরকারি তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, বিগত দশকে বিপুল হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা। কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতার এই ব্যাপক বৃদ্ধির পিছনে কী কারণ দেখতে পাচ্ছেন মনোবিদেরা?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উঠে আসছে বর্তমান যুব সম্প্রদায়ের অসহিষ্ণুতা এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা। আরও ভেঙে বিশেষজ্ঞরা দেখাচ্ছেন, ১৫ থেকে ২৫ এবং ২৫ থেকে ৩৫, এই দুই সময়কালে যুব সম্প্রদায়ের আত্মহত্যার প্রবণতার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে। ১৫ থেকে ২৫, এই সময়কালে যুব সম্প্রদায়ের শরীরের পাশাপাশি মনেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়ে চলে। যোগ হয় বিভিন্ন চাওয়া-পাওয়া এবং তার থেকে অবসাদ। এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন কেউ কেউ। উল্টোদিকে ২৫ থেকে ৩৫, এই সময় কালে হঠাৎ করেই জীবনের দিশা হারিয়ে ফেলতে দেখা যায় যুব সম্প্রদায়ের একটি অংশকে। এতদিন অবধি যা যা কামনা করে এসেছিল সে, হঠাৎ করেই সেইসব আর কোনোদিনই পাওয়া হয়ে উঠবে না, এইরকম একটা বোধ কাজ করতে শুরু করে তাদের মধ্যে। ফলত, তার সমাধান হিসেবে বেছে নেয় সেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার রাস্তাই।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি পরিসংখ্যান অত্যন্ত চোখে লাগার মতো। সেটি হল পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যার অনুপাত। সারা বিশ্বের নিরিখে দেখলে, মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের আত্মহত্যার প্রবণতা সারা বিশ্বেই অনেক বেশি। এর ফলে এরকম একটা ধারণা করে নেওয়াই যায় যে, পুরুষদের থেকে মহিলারা মানসিকভাবে অনেক বেশি শক্তপোক্ত অথবা যে কোনও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে বেশি তৈরি। অবশ্য অনেকে পুরুষদের সংবেদনশীলতা বেশি, এই এই যুক্তিও খাড়া করেছেন।

কিন্তু সেই সকল যুক্তি বা পরিসংখ্যান ধাক্কা খায় উন্নয়নশীল অথবা নিম্নআয়ের দেশগুলির দিকে চোখ রাখলে। বিশেষ করে ভারতে পুরুষদের আত্মহত্যার হার মহিলাদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এর কারণ হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের আধিপত্য। একথা ঠিক যে বিগত কয়েক দশকে সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে কর্মক্ষেত্রের চেহারা। আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে স্ট্রেস এবং মানসিক ক্লান্তি। এবং এখনও যেহেতু কর্মক্ষেত্রে পুরুষদেরই সংখ্যাধিক্য, তাই তাদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
১৪ মাসে আত্মহত্যা ১৩ কর্মীর, ছাঁটাইয়ের পথে আরও ২০ হাজার; খাদের কিনারায় বিএসএনএল?

তবে শুধুমাত্র কর্পোরেট কালচারেই নয়, ব্যাপক পরিমাণে আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে গ্রামীণ ক্ষেত্রগুলি থেকেও। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে কৃষক আত্মহত্যা নিয়ে বারবার উত্তাল হয়েছে দেশের রাজনৈতিক মহল। সম্প্রতি লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে সামনে এসেছে বিপুল হারে পরিযায়ী শ্রমিকদের আত্মহত্যার ঘটনাও। এখনও যেহেতু কৃষিক্ষেত্রে বা ভারী পরিশ্রমের কাজ গুলিতেও পুরুষদেরই সংখ্যাধিক্য দেখা যায়, তাই আত্মহত্যার ঘটনাও বেশি পুরুষদের ক্ষেত্রে, এই সন্দেহ কিন্তু অমূলক নয়।

সুতরাং একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক ডিপ্রেশনের সঙ্গেই নিবিড় যোগ থেকে যাচ্ছে অর্থনৈতিক ডিপ্রেশনেরও। অবাস্তব লক্ষ্য ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়ার ফলে তাদের উপর তৈরি হচ্ছে অকথ্য মানসিক চাপ। এ প্রসঙ্গে বাবা-মায়েদের একটি সদর্থক ভূমিকা পালন করার কথা। ভূমিকা পালন করার কথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মহলেরও। কিন্তু নিজের বাড়িতে অথবা বিদ্যালয়ের মধ্যেই ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মহত্যার ঘটনাও এর মধ্যে সামনে এসেছে একাধিকবার।

সুতরাং আত্মহত্যা প্রতিরোধ নিয়ে যতই তর্ক-বিতর্ক বা সেমিনার হয়ে যাক না কেন, মূল প্রতিরোধের বিষয়টি কিন্তু আটকে থাকছে খুবই কেন্দ্রীভূত একটি জায়গায়। আর্থিক এবং সামাজিক বৈষম্য দূর না হলে কখনোই কমানো যাবে না আত্মহত্যার সংখ্যা। কারণ, ভারতে অন্ততপক্ষে মহিলাদের ক্ষেত্রে যে আত্মহত্যার ঘটনাগুলি সামনে এসেছে তার পিছনে ছিল ধর্ষণ, দাম্পত্য হিংসা অথবা কোনও না কোনও ভাবে সমাজে ছোট করে দেখানোর প্রচেষ্টা। চাঞ্চল্যকর একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, আত্মহত্যার প্রবণতা পুরুষদের মধ্যে বেশি হলেও আত্মহত্যার কথা কিন্তু বেশি চিন্তা করেন মহিলারাই। কিন্তু এই চিন্তা থেকে কাজটি করে ফেলার মধ্যে যে স্তরগুলি রয়ে যায়, সেই স্তরগুলিতে নিজেদের অনেক বেশি সামলে নিতে পারে মেয়েরা।

আরও পড়ুন
দেশে প্রতিদিন গড় আত্মহত্যা ৩৮৭ জনের, তৃতীয় স্থানে বাংলা : কারা বেছে নিচ্ছেন এই পথ?

এছাড়াও ২০১৭ সালে একটি গবেষণায় আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছিল পুরুষদের আত্মহত্যার বৃদ্ধি কারণের উপর। সেখানে গবেষকরা দেখিয়েছিলেন, যে প্রচলিত ধ্যানধারণায় পুরুষদেরকে বড় হয়ে উঠতে হয়, সেটাই জীবন যুদ্ধে তার হার মেনে নেওয়ার অন্যতম কারণ। ‘ছেলেরা কাঁদে না’ এই ধরণের কথা শুনে বড় হয়নি এমন পুরুষ মনে হয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাই আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসার পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেখানে মেয়েরা সেটা রাগ করে, ঝগড়া করে অথবা কান্নাকাটি করে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে, সেখানে পুরুষেরা তাদের প্রথাগত পৌরুষে দাগ লাগবে মনে করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরোটা চেপে রাখে মনের ভিতর। একটা সময় এই চাপই হয়ে দাঁড়ায় পাহাড়প্রমাণ।

সুতরাং বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসে আরও গভীরে গিয়ে ভাবা দরকার এর মূল কারণগুলি। সামাজিক, অর্থনৈতিক অথবা মানসিক কারণগুলিকে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে কিন্তু বড় ভুল হয়ে থেকে যাবে সেটা। আরও খোলা মনে এই সমস্যার দিকে না তাকালে, আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়টি খাতায়-কলমেই থেকে যাবে। তার আড়ালে ঝরে যাবে আরও কতগুলো প্রাণ, যাদের মনখারাপের খবর কখনোই সেভাবে রাখতে পারিনি আমরা। সেই প্রবণতা কমলেই সুস্থ একটা সমাজের দিকে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে আগামী দিনগুলিতে।

(ঋণ – তোর্সা নন্দী)

আরও পড়ুন
কর্মীরা বেতনহীন মাসের পর মাস, সঙ্গে ছাঁটাইয়ের হুমকি; বিএসএনএলের বর্তমান পরিস্থিতির পিছনে কোন রাজনীতি?

Powered by Froala Editor

More From Author See More