১৪ মাসে আত্মহত্যা ১৩ কর্মীর, ছাঁটাইয়ের পথে আরও ২০ হাজার; খাদের কিনারায় বিএসএনএল?

বিএসএনএল-এর কর্মী কথাটা শুনলেই এক বিচিত্র অনুভূতি হয় মানুষের। একদিকে লাগাতার প্রচার, তাঁদের ব্যর্থতার কারণেই সংস্থার আয় এত কম। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের বেতন না পাওয়া কর্মীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। অথচ সেদিকে নজর না দিলেও কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়ে তৎপর কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের শুরুতেই ৩০ হাজার ঠিকাকর্মীকে কাজ থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য করা হয়েছে। আর এর মধ্যেই আরও ২০ হাজার কর্মীকে ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রত্যেক ব্রাঞ্চ এবং রিজিওনাল ম্যানেজারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছে বিএসএনএল-এর শ্রমিক সংগঠনগুলি। একাধিক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ ইতিমধ্যে কলকাতায় রাজ্য অফিস অভিযানও করে। কিন্তু সেখানে তাঁদের প্রথমেই ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। পড়ে পুলিশের মধ্যস্থতায় আলোচনা হলেও কোনো সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসেনি। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ইতিমধ্যে ইউনিয়নের তরফ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে সংস্থার চেয়ারম্যান পিকে পুরওয়ারকে।

বিএসএনএল কর্মীদের সঠিক সময়ে বেতন না পাওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ ঠিকাকর্মী প্রায় ১ বছরের উপর বেতন পাননি বলে ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যদিও এটা কোনো নতুন বিষয় নয়। করোনা পরিস্থিতির আগেও এমন অভিযোগ উঠেছে বারবার। গতবছর নভেম্বর মাসে অফিসেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন এক ঠিকাকর্মী। এর মধ্যে গত ১৪ মাসে ১৩ জন ঠিকাকর্মী আত্মহত্যা করেছেন বলে ইউনিয়নের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। বাকিদের অবস্থাও একইরকম। কোনোরকমে জীবনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু কর্মীদের এই দুরাবস্থার দিকে নজর না দিয়েই ছাঁটাইয়ের অমানবিক সিদ্ধান্ত সত্যিই অবাক করে।

বিএসএনএল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে অবশ্য জানানো হয়েছে অত্যন্ত অল্প আয় এবং বিপুল পরিমাণ ধারের বোঝা মাথায় নিয়ে খরচ কমানোর আর কোনো রাস্তাই খোলা নেই। ইতিমধ্যে নোকিয়া কোম্পানি জানিয়ে দিয়েছে তারা ৯০০ কোটি টাকার ধার শোধ না হওয়া পর্যন্ত বিএসএনএল-এর সঙ্গে আর কোনো কাজ করবে না। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, একটি সরকারি সংস্থার এমন দুরাবস্থার পিছনে প্রকৃত কারণ কী? সত্যিই কী কর্মীদের অপদার্থতাই এসবের জন্য দায়ী?

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বারবার দেখেছি, কীভাবে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বারবার পিছিয়ে পড়েছে বিএসএনএল। আবার এও দেখেছি, অন্যান্য টেলিকম সংস্থার মাথার উপর যখন বিপুল ঋণের বোঝা, সেখানে কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকেই ঋণ নিতে দেওয়া হয়নি বিএসএনএলকে। খানিকটা আর্থিক সাহায্য পেলে হয়তো সংস্থা ঘুরে দাঁড়াতে পারত। এখানেই শেষ নয়, ৪জি টেকনোলজি ছাড়া যেখানে এখন মোবাইল কানেকশনের কথা ভাবাই যায় না, সেখানে নিলামে অংশ নিতেই দেওয়া হয়নি বিএসএনএলকে। অথচ রিলায়েন্স-জিওর ৪জি পরিষেবার বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রীর ছবি। সরকারি সংস্থাকে কি পিছিয়ে দিচ্ছে সরকারের পরিকল্পনাই? এর মধ্যেই শাসকদলের সাংসদের মুখে শোনা যায় বিএসএনএল-এর কর্মীরা নাকি অনেকেই দেশদ্রোহী। তাঁদের ছাঁটাই করা হবে। বর্তমান কর্মী ছাঁটাইয়ের সঙ্গে কি তার কোনো সম্পর্ক আছে? নাকি সেটা নিছক কাকতালীয়?

এক বছরের মধ্যে ৫০ হাজার ঠিকাকর্মীর ছাঁটাই নানা প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। এই সময় যখন বহু সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে কোনোক্রমে বেঁচে রয়েছেন, তখন এমন সিদ্ধান্তের অমানবিকতা নিয়ে সন্দেহ থাকে না। পাশাপাশি এই প্রশ্নও ওঠে, সমস্ত শ্রমিককে যথাযথ বেতন দিয়ে প্রয়োজন মতো কাজ করাতে পারলে কি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না বিএসএনএল? নাকি টেলিকম মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ কিছুদিন আগে যেভাবে বিএসএনএল-এর পরিসর কমিয়ে আনার কথা বলেছিলেন, তারই ফলশ্রুতি এই সিদ্ধান্ত। আসলে শেষ পর্যন্ত এই সরকারি সংস্থার অস্তিত্বই মুছে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে ভিতরে ভিতরে?

আরও পড়ুন
পাবজি-ফৌজি চর্চা, রবীন্দ্রনাথ ও কিছু 'হযবরল'

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More