খাতায়-কলমে বিভাগ রয়েছে বাংলার প্রতিটি জেলাতেই; মানব-পাচার কি রোখা যাচ্ছে আদৌ?

হিউম্যান ট্রাফিকিং কিংবা মানব পাচার, নিত্যদিনই এই ট্র্যাজেডির সাক্ষী থাকছে ভারত। তবে এই ঘৃণ্য অপরাধকে ঠেকাতেই তৈরি হয়েছিল অ্যান্টি-হিউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিট(এএইচটিইউ)। গত জুন মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এই বিশেষ পুলিশি সেল বা ইউনিট তৈরির জন্যই বরাদ্দ করেছিল ১০০ কোটি টাকা। তবে অ্যান্টি-হিউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিট গঠনের কাজে কতটা তৎপর ভারত? সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ এতকিছুর পরেও ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে উপস্থিত নেই এই ইউনিট। আর যেখানে আছে?

রিপোর্টে উঠে এসেছে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের কয়েকটি হাতে-গোনা রাজ্য ছাড়া প্রত্যেকটি জেলায় এই ইউনিটের উপস্থিতি নেই। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে বাংলা যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গেই কাজ করছে মানব পাচারের বিরুদ্ধে। তবে পরিসংখ্যান বলছে ২০১৮ সালের দেশের পাচার ঘটনার ৭ শতাংশই হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। সেখানেই তৈরি হচ্ছে ধোঁয়াশা। সত্যিই কি তৎপর আমাদের রাজ্য? সত্যিই কি এই বিশেষ ইউনিট বাংলায় কেবলমাত্র মানব পাচারের মতো একটা গুঢ় অপরাধকে তদন্ত করতে পারছে ১০০ শতাংশ মনযোগ দিয়ে?

আইনজীবীদের, মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজকর্মীদের নিয়ে গঠিত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ‘গরানবোস গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র’-ও লড়ে যাচ্ছে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তবে তাঁদের পরিসংখ্যানেই উঠে আসছে পশ্চিমবঙ্গে প্রতি জেলায় অ্যান্টি-হিউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিট থাকলেও, তার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকরা জড়িত অন্য নানান প্রশাসনিক কাজের সঙ্গেও। ফলে পাচারের ক্ষেত্রটিকেই প্রধান উপলক্ষ করে তদন্ত করা সব সময় সম্ভব হয়ে উঠছে না। প্রশ্ন উঠছে এই বাংলায় সেলের ভূমিকা নিয়েও। সরকারের এই আলাদা পুলিশি বিভাগ তৈরির মূল উদ্দেশ্যই মানব পাচারকে আটকানো। সেক্ষেত্রে এই ইউনিটেরই দায়িত্ব থানা থেকে মানব পাচার সংক্রান্ত কেসগুলির হস্তক্ষেপ করা এবং তার যথাযথ তদন্ত করা। সেখানেই থেকে যাচ্ছে বড়সড় ফাঁক। প্রতিটি থানায় কয়েক বছর ধরে জমা পড়ে আছে এমন প্রচুর অভিযোগ। তবে কি সার্ভাইভারদের প্রত্যেককে আদালতে গিয়ে আবেদন করতে হবে যাতে এই মামলায় হস্তক্ষেপ করে এএইচটিইউ? তবে এই বিশেষ সেল গঠনের যৌক্তিকতা কোথায়?

‘গরানবোস গ্রামবিকাশ কেন্দ্রে’র এক সক্রিয় প্রতিনিধি শুভশ্রী রপ্তান মানব পাচারের প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই উল্লেখ করেন, “এটি একটি শৃঙ্খলবদ্ধ প্রক্রিয়া। একমাত্র মূল পাচারচক্রী ছাড়া পাচারকাণ্ডে জড়িত অন্যান্যরা কেউ-ই জানেন না পাচারের আসল ঠিকানা কী। পাচারের পুরো পথটাকেই পাচারকারীরা ভেঙে নেন ছোটো ছোটো ভাগে। ধরা যাক, কোনো এক ব্যক্তিকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা থেকে পাচার করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তাঁকে কেউ সেখান থেকে কলকাতা নিয়ে যায়। কলকাতা থেকে তাঁকে হাওড়া নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে থাকেন অন্য কেউ। সেখান থেকে আবার তাঁর পথ বদলে যায় অন্য জেলায় কিংবা রাজ্যে। ফলে পুরো বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে সার্কামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স। নাহলে এই পুরো শৃঙ্খলটিকেই সাজানো মুশকিল”। গোলযোগ বাঁধে সেক্ষেত্রেই। সাধারণ পুলিশ আধিকারিকদের বাড়তি কাজ হিসাবে পাচার-তদন্তে নিয়োগ করায় তাঁরাও সুযোগ পান না পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার। খুন, ভিআইপি অ্যাটেন্ড, আঞ্চলিক দাঙ্গা সামলানোর কাজের মধ্যে মানব পাচারের তদন্ত কোথাও গৌণ হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন
সম্মানজনক কাজ নেই; ড্রাগ পাচার চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মহিলারা

পাশাপাশিই সাধারণ পুলিশ আধিকারিকদের এই কাজে নিয়জিত করার আরও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হল তাঁদের তদন্তক্ষেত্র। কলকাতার কোনো থানায় পাচারের অভিযোগ দায়ের করা হলে, সেই থানার আধিকারিকেরা স্বাভাবিকভাবেই তদন্ত করবেন রাজ্যের মধ্যে। অথচ সেই ব্যক্তিকে হয়তো পাচার করা হয়ে গেছে ভিন রাজ্যে। সেই রাজ্যের পুলিশের কাছে এই রিপোর্ট নথিভুক্ত করা হচ্ছে ভিন্ন ফাইল হিসাবেই। ফলে দুটির মধ্যে কোনো সংযোগস্থাপন হচ্ছে না কোথাও। একটি পূর্ণ মানব-পাচারের প্রমাণ ছড়িয়ে থাকে অনেকগুলি রাজ্যে। কাজেই এই তদন্ত জাতীয় স্তরেই হওয়া আবশ্যক। 

ক্রমাগত মানব-পাচার বেড়ে চলার একটি কারণ এটিও। এই অসঙ্গতির কারণেই সার্ভাইভার অনেক সময়ই পরবর্তীকালে সমস্যার সম্মুখীন হন আদালতে গিয়ে। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাঁর বক্তব্য কোথাও মিথ্যা কিংবা মনগড়া হয়ে যায়। বা পাচার হলেও তার কোনো প্রমাণ না থাকায় অপরাধী বেকসুর খালাস হয়ে যায়। ছাড়া পেয়ে আবার নতুন চক্রের ফাঁদ পাতে সে। শিকার হন আরও অনেকে।

আরও পড়ুন
লকডাউনের মধ্যেই চলছে পাচার, মেক্সিকোয় উদ্ধার ১৫০০ বিরল প্রজাতির কাছিম

এই প্রসঙ্গেই শুভশ্রী রপ্তান জানান, “আমাদের কাছে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পাচারচক্রীদের একটি সম্পূর্ণ তালিকা। তাতে নাম রয়েছে অন্তত ৩০০ জনের। সার্ভাইভারদের থানায় করা এফআইআরের ভিত্তিতেই এই তালিকা। তবে এমনও অনেক পাচারকারী রয়েছেন যাঁদের নাম রয়েছে একই জেলার বিভিন্ন থানায়। এবং সংশ্লিষ্ট থানায় তিনি অভিযুক্ত অন্য অন্য পাচার ঘটনার সঙ্গে। তবে প্রত্যেকটি এফআইআরই তাঁর অন্য অন্য নামে। কখনও তিনি ‘অ্যালিস’, কখনও ‘রাজু’, কখনও ‘ফিরোজ’। এবং এই নামগুলো আমার মনগড়া নাম নয়। এই তিন নামেই তার এফআইআর রয়েছে বিভিন্ন থানায়। ফলে এই তিন ব্যক্তিই যে একজন সেই প্রমাণ হাতের সামনে থাকলেও প্রমাণিত হয় না অনেকক্ষেত্রেই”। 

আবার অনেকক্ষেত্রে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলেও তা পকসো আইনের আওয়ায় শুধু নথিভুক্ত করা হয়। ট্রাফিকিংয়ের ৩৭০ ধারা সেখানে উপেক্ষা করা যাওয়া হয় অনেকটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই। ২০১৬ সালে এনসিআরবি’র (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বিউরো) প্রকাশিত নথিতে দেখা গিয়েছিল ভারতের মোট পাচারের ৪৪ শতাংশের সঙ্গেই জড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের নাম। এই রিপোর্ট আসার পর থেকেই ৩৭০ ধারায় মামলা নথিভুক্তের প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে অনেকটাই। ফলে যেটুকু পুলিশি রিপোর্ট সামনে আসে, সেটা বাস্তব চিত্র নয়। এর পিছনেও রয়েছে একটা বড় অজানা অধ্যায়।

“উত্তর ২৪ পরগনার এক সার্ভাইভারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম উদ্ধারের পর। তবে প্রথমে কোনও কথাই বলছিলেন না তিনি। কোথাও গিয়ে সেই ট্রমাটা থেকেই বেরিয়ে আসতে পারছিলেন না। কাউন্সিলিংয়ের পর যখন তিনি পাচারকারীর বর্ণনা দিলেন, তা হুবহু মিলে গেল দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক চক্রীর সঙ্গে। ঘটনাচক্রে সেই চক্রীর ফটো আমার কাছে ছিল। সেই ছবি দেখাতেই রীতিমত চমকে ওঠেন তিনি। তবে তিনি এই চক্রীকে ‘রাজু’ বা ‘অ্যালিস’ নামে চিনতেন না। চিনতেন ‘ভোলা’ নামে।” 

বাস্তবের এমনই এক ঘটনা অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনছিলেন শুভশ্রী দেবী। তাঁর এই বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, যদি অ্যান্টি-হিউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিট প্রথম থেকেই বিষয়টির তদন্ত করত তবে পরের ঘটনাগুলি ঘটত না কোনোভাবেই। তবে তদন্ত এবং পুলিশি বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগের বিষয়ে প্রশ্ন উঠলেও, উদ্ধারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন অ্যান্টি-হিউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিট। তৎপরতার সঙ্গেই এমন উদ্ধারকার্যের রয়েছে বহু উদাহরণও। এমনকি বাইরের রাজ্যে গিয়েও অনেকক্ষেত্রেই উদ্ধার করা হয়েছে মানুষকে। কিন্তু শুধুই কি তাঁদের কাজ এইটুকু পরিসরে সীমাবদ্ধ? 

পাশাপাশি প্রশ্ন থাকছে এই ইউনিটের পরিকাঠামো নিয়েও। একটি তদন্তের কারণে এক বা একাধিক আধিকারিককে বারবার ভিন্ন রাজ্যে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে যাতায়াতের পুরো খরচই বহন করতে তাঁদের নিজেদের। সেটাই বা কতটা সম্ভব তাঁদের পক্ষে? ফলে পরিকাঠামো, আর্থিক সহযোগিতা, টেকনিক্যাল সহযোগিতা যদি সরকার থেকে না প্রদান করা হয়, তবে কোনোদিনই রেশ পড়বে না এই অপরাধের ধারায়। শেষ করা যাবে না মানব-পাচারকে। কিন্তু কবে এই ব্যাপারে আরও সতর্ক হবে প্রশাসন? একরাশ ধোঁয়াশার মতোই দোলাচলে এই প্রশ্ন...

Powered by Froala Editor

More From Author See More