তাঁর চেষ্টাতেই প্রাণ ফিরে পেয়েছিল হাভানা, ক্যানসার কেড়ে নিল ইউসেবিও লিল-কে

জুলাইয়ের শেষের দিন ছিল সেটি। বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতি তখনও ঠিক হয়নি। কিউবার টিভিতে খবরের পাশাপাশি চলছে অন্যান্য সব অনুষ্ঠানও। হঠাৎই থেমে গেল সেসব। খারাপ হয়ে গেল কিছু? না, ঠিক তা নয়। তার বদলে শুরু হল একটি বিশেষ খবর। মাত্র কিছুক্ষণ আগেই মারা গেছেন ইউসেবিও লিল। সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধ বেশ কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আর ধরে রাখতে পারলেন না ডাক্তাররা। আর সেই খবরই ভেসে উঠল টিভি পর্দায়। গোটা কিউবা স্তব্ধ। স্তব্ধ হাভানা…

যার মৃত্যু থামিয়ে দিল স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, থামিয়ে দিল টিভিকে; তিনি তো সাধারণ কেউ হবেন না! ইউসেবিও লিল সেই অসাধারণদেরই এক প্রতিনিধি। অভিনেতা বা রাষ্ট্রনেতা নয়; তিনি ছিলেন একজন ঐতিহাসিক। হাভানাতেই জন্ম তাঁর, সেখানেই বেড়ে ওঠা। শহরের ঐতিহ্য, ইতিহাস তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল প্রবলভাবে। সেসবই আঁকড়ে ধরেছিলেন; হাভানাও পেয়েছিল তার প্রাণপুরুষকে। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে ওল্ড হাভানার জন্য। ইতিহাসে ভরা এই শহরকে মৃত্যুর মুখ থেকে তুলে এনেছিলেন প্রায় একার চেষ্টায়। কেন করবেন না ইউসেবিও? এ যে তাঁর প্রাণের শহর… 

বাবাকে কাছে পাননি সেভাবে; হয়তো মনেও নেই তাঁর। মা-ই ছিলেন সব; অত্যন্ত কষ্ট করে মানুষ করেছিলেন ইউসেবিও’কে। আর্থিক অবস্থার জন্য স্কুলে বেশিদূর অবধি পড়তে পারেননি। তাতে কী হয়েছে? পড়াশোনার জন্য তো নিজের ইচ্ছা থাকা দরকার। উপায় তো নানাভাবে পাওয়া যায়। নিজে নিজেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। আর সেই জোরেই পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন। আর ভালোবেসেছেন নিজের শহরকে। 

হাভানার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক অংশ হল ওল্ড হাভানা। পুরনো গির্জা, বাড়ি, পথঘাট— ইতিহাস যেন পরতে পরতে লেগে আছে এখানে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অযত্ন ও পরিকল্পনার ওভাবে ওল্ড হাভানা ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছিল। হারিয়ে যেতে বসেছিল তার ঐতিহ্য। সহ্য করতে পারেননি ইউসেবিও লিল। তাঁর সিগনেচার ধূসর কোট পরে হেঁটে বেরিয়েছেন ওল্ড হাভানার রাস্তায়। ছুঁয়ে দেখেছেন সেই ইতিহাস। না, বাঁচাতেই হবে এই শহরকে। কেউ যদি এগিয়ে না আসে, তিনি একাই চেষ্টা করে যাবেন। ওল্ড হাভানাকে বাঁচানোর জন্য নিয়ে এলেন বিশেষ প্রোজেক্ট। আর এই কাজেই পাশে পেলেন আরও দুজনকে। কিউবার প্রাণপুরুষ ফিদেল কাস্ত্রো এবং তাঁর ভাই রাউল কাস্ত্রো। ১১ বছর ধরে চলেছে এই কাজ। এরই মধ্যে ১৯৬৭ সালে ইউসেবিও হয়েছেন হাভানার ‘এল হিস্টোরিয়াডর’; হাভানা শহরের ঐতিহাসিক। 

আরও পড়ুন
আগামী পাঁচ বছরে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা, জানাল আইসিএমআর

ইউসেবিও লিলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই ওল্ড হাভানা আবার যেন জীবন ফিরে পেল। তার ইতিহাস জেগে উঠল সবার মধ্যে। তাঁরই চেষ্টায় ১৯৮২ সালে এই শহরটি ইউনেস্কোর হেরিটেজের তালিকায় জায়গা পেল। একটা শহরকে কতখানি ভালোবাসলে তার জন্য এতকিছু করা যায়? তার ইতিহাসকে বাঁচানোর জন্য সবকিছু করা যায়? এমনই ছিল ইউসেবিও’র ভালোবাসা। কিউবার মানুষদের কাছে তিনি হাভানার ‘চিরন্তন প্রেমিক’। শুধু কিউবা নয়, বিশ্বজুড়ে নানা সম্মান পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তার মধ্যেই দেখা দিল ক্যানসার। মৃত্যু কাছেই; তাও প্রাণ যেন যৌবনেই আছে। ২০২০-এর ৩১ জুলাই সেইটুকুও কেড়ে নিল। হাভানা হারাল তার প্রেমিককে। কিন্তু সেই হারানো তো শারীরিক; ভেতরে ভেতরে ইউসেবিও তো রয়েই গেছেন হাভানার আত্মায়। তাঁর মৃত্যুর পর যখন কিউবার প্রতিটা বাড়ি থেকে সাদা চাদর টাঙানো হয়েছিল, সেই শান্তির চিহ্নই যেন দেখতে চেয়েছিলেন ইউসেবিও। ধ্বংস নয়; সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে, ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটাকে আপন করে নিতে হয়। ওল্ড হাভানার আজ মন খারাপ। মন খারাপ কিউবার মানুষদের। ধূসর কোট পরে মানুষটা আর তো হাঁটবেন না এই পথে… 

আরও পড়ুন
স্টেজ থ্রি ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত, চিন্তিত অনুরাগীরা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সারাজীবন লড়েছেন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে, ক্যানসার কেড়ে নিল জন লুইসের প্রাণ