মুম্বাই থেকে বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন মনজিনিস, ক্যানসারের কাছে হার মানলেন বাঙালি উদ্যোগপতি

জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী হোক বা অফিস পার্টি— সমস্ত জায়গায় কেক চাই-ই চাই। আর কেকের নাম বললেই প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় আমাদের মুখে চলে আসবে আরও একটি নাম, মনজিনিস! বাংলার কেক বিপণনের জগতে যে নামটি আজ প্রায় সবার সঙ্গী। অবশ্য এখন আর মনজিনিস নয়; মিও আমোরে। নাম বদলালেও স্বাদের ভাগ হয়নি! আর এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত আছেন আরও এক বাঙালি। বলা ভালো, ইনি না থাকলে বাংলায় এত জনপ্রিয় হত না এটি। বলা হয় বাঙালি নাকি ব্যবসা বোঝে না। যুগে যুগে এমন কথার উত্তর হয়ে উঠে এসেছেন অনেকে। তাঁদেরই একজন হলেন অর্ণব বসু। মিও আমোরে’র কর্ণধার তিনি। দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। শেষপর্যন্ত হার মানতে হল তাঁকে। কলকাতারই এক বেসরকারি হাসপাতালে কয়েকদিন আগে চিরতরে চোখ বুজলেন তিনি। পড়ে রইল তাঁর সাধের কেকের দোকান ও কারখানা…

বেকারির ব্যবসায় আসবেন, এমন কোনো ইচ্ছা ছিল না তাঁর। বাবার রেলের চাকরি, বদলির চাকরি। মুম্বইতেই বেড়ে উঠছিলেন তিনি। পড়ে একটু বড়ো হওয়ার পর কলকাতায় পা রাখা। আর পাঁচজন বাঙালি ছেলের মতো পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জগতে ঢুকে পড়েছিলেন। ভালো রোজগারও হত। আশির দশকে এসে জীবনের মোড় পুরো ঘুরে গেল। মুম্বাইয়ে তাঁর এক বন্ধু ছিল, নাম তাইজুন খোরাকিওয়ালা। প্রসঙ্গত, এই পরিবারেরই নিজস্ব সংস্থা হল মনজিনিস।

বন্ধু তাইজুনের ডাকে সৌদি আরবে তাঁর বেকারি ব্যবসায় যুক্ত হলেন তিনি। এই সময়ই সমস্ত খুঁটিনাটি শিখে নিয়েছিলেন অর্ণববাবু। দীর্ঘ সাত বছরের আরব-জীবন তাঁর গতিপথ ঠিক করে দেয়। সাত বছর পর দেশে ফিরে পশ্চিমবঙ্গে শুরু করলেন কেকের ব্যবসা। মুম্বাই থেকে ‘মনজিনিস’-এর কেক বাংলায় নিয়ে এলেন তিনি। রয়্যালটির বিনিময়ে সেই নামও পেয়ে গেলেন। সেই শুরু হল মনজিনিস। সময়টা আশির দশকের একদম শেষভাগ। তবে শুধু কেক বিক্রিই নয়; কেক তৈরির কারখানাও খুলে ফেললেন তিনি। ১৯৮৯ সালে কসবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে শুরু ‘সুইটস ফুডস’-এর কারখানা। এখনও যা রমরমিয়ে চলছে। মনজিনিস বা মিও আমোরে নয়, আরও বিভিন্ন সংস্থার জন্য নানা খাবার প্রস্তুত করে এই সংস্থা।

মিও আমোরে বলতেই মনে পড়ে প্রতিটা জায়গায় একটি করে দোকান। কেক, পেস্ট্রি থেকে শুরু করে হরেক রকম খাবারের জায়গা এখানে। স্কুল-কলেজ থেকে ফেরার পর, অফিস থেকে আসার সময় যেখানে অনেকেই ঢুঁ মারেন। মনের মতো খাবারটি কিনে চলে যান বাড়ি; নয়তো বাইরেই প্রিয় মানুষটির সঙ্গে গল্প করতে করতে সময় কাটান। মনজিনিসই বলুন বা মিও আমোরে, এই ছোট্ট দোকানটি কত গল্পেরই না সাক্ষী! এমন জিনিসই আমাদের সামনে হাজির করিয়েছিলেন অর্ণব বসু। ঢাকুরিয়ায় প্রথম শুরু হয়েছিল এমন দোকান। আজ শুধু কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলেই সেই দোকানের সংখ্যা ২৫০-র অঙ্ক ছাড়িয়েছে। আরও কত জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে সেই উদ্যোগ! নতুন প্রজন্মের বাঙালির আবেগের জায়গা তৈরি হয়ে আছে এই একটি প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে।

নিজের হাতে এমন নস্টালজিয়া তৈরি করে গিয়েছিলেন। অর্ণব বসু না থাকলে মনজিনিস বা মিও আমোরে-কে কি কেউ পেত? ২০১৮ সালে যখন পাড়ায় পাড়ায় মনজিনিসের চিরপরিচিত সাইন বদলে গেল বেগুনি রঙে, সামনে এল মিও আমোরে; অনেকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু স্বাদে সেই বদল আসতে দেননি অর্ণববাবু। ভেতরে ভেতরে যে মারণ রোগ বাসা বাঁধছে, সেটা কি বুঝতে পারছিলেন? আজকে মিও আমোরে-র এমন রমরমার যুগে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই অত্যন্ত গর্বিত তিনি। বাঙালি হিসেবে আমরাও তাঁর নাম গর্বের সঙ্গে নিতে পারি। আরও বড়ো জায়গায় হয়ত দেখে যেতে পারতেন নিজের প্রতিষ্ঠানকে। আরও নতুন নতুন ভাবনা হয়তো সামনে আসত। ক্যানসার সেই সবটা থামিয়ে দিল। মিও আমোরে বন্ধ হয়নি; মনজিনিসও নতুন করে নিজেদের দোকান খুলেছে। উইঙ্কিস, জলযোগও নিজের সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছে। শুধু আসল মানুষটিই আর নেই… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More