আত্মহত্যা করলেন কাদম্বরী, মৃত্যুসংবাদ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা শ্বশুরমশাই দেবেন্দ্রনাথের!

১৮৮৪ সালের এক শান্ত বিকেলের কথা। আস্তে আস্তে বৈশাখের গরম ছড়িয়ে পড়ছে শহরে। শহরের চিলেকোঠাগুলো অলস যাপনে মেতে ওঠে। রাস্তায় কখনও কখনও শোনা যাচ্ছে ফেরিওয়ালার ক্লান্ত ডাক, আশপাশের বাড়ি থেকে ছোটোরা উসখুস করছে কখন একটু বেরোবে। এই অদ্ভুত স্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে জোড়াসাঁকোর সম্ভ্রান্ত ঠাকুরবাড়িতেও। শুধু কি সম্ভ্রান্ত! শিল্পে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে ওই বাড়ির জুড়ি মেলা ভার। আপাতত বাড়িতে বিশেষ কেউ নেই। তেতলার একটি ঘর থেকে অপেক্ষার নিঃশ্বাস শোনা যায়। একজন তরুণী চুপচাপ বসে আছেন। কখনও গুনগুন করে উঠছেন, কখনও বাগানের ফুলগুলোর গায়ে জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন। বিকেল একটু গড়ালেই তাঁকে নিতে আসবে সবাই। আসবেন তাঁর স্বামী। নিয়ে যাবেন তাঁর নতুন জাহাজে। ভারী আনন্দ মেয়েটির। তাই আগে আগেই তৈরি করে নিচ্ছেন নিজেকে।

ঘড়ির কাঁটা বড়ো অবুঝ; নিষ্ঠুরও বটে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, বিকেল গড়িয়ে রাত। কিন্তু, কেউ যে আসে না! তরুণী যেন একটু হেসে উঠলেন। চোখে জল, মনে ঝড় চলছে উথালপাথাল। স্বামীও এলেন না; এমনকি যাকে ভরসা করতেন প্রবলভাবে, যার লেখায় বেঁচে উঠতেন, তিনিও এলেন না। আস্তে আস্তে তরুণী এগিয়ে গেলেন দেরাজের দিকে। বের করলেন একটি শিশি - আফিমের। অনেকটা খেয়ে নিলেন একসঙ্গে। আহা, এই ঘুম বড়ো নিশ্চিন্তির! শুয়ে পড়ল শরীরটি। আস্তে আস্তে ঘনিয়ে এল অন্ধকার। ১৮৮৪ সাল, ১৯ এপ্রিল। ঠাকুরবাড়ির তেতলার ঘরে মৃত্যুকে বেছে নিলেন কাদম্বরী দেবী।

কাদম্বরীর আত্মহত্যা নিয়ে বাংলায় এখনও প্রচুর চর্চা হয়। অনেকে অনেকরকম দিকের সন্ধান দেন। সেখানে জড়িয়ে থাকে সত্যি; জড়িয়ে থাকে মিথ, গুজবও। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন স্বামী। রূপে-গুণে ঠাকুর পরিবার তো বটেই, গোটা বঙ্গসমাজ মোহিত। কাদম্বরী দেবীও কম কিছু ছিলেন না। সাহিত্যবোদ্ধা তো ছিলেনই; সেই সঙ্গে ছিলেন দুর্দান্ত অভিনেত্রী। জীবিতকালে ঠাকুরবাড়ির নানা নাটকে সদর্পে অভিনয় করে গেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথও স্ত্রীর এমন গুণের প্রশংসা করতেন। সবই ছিল, আবার ছিল না অনেক কিছুই। এত ভিড়ের মধ্যে একপ্রকার একাই ছিলেন কাদম্বরী দেবী। তেতলার ওই ঘরটিই ছিল তাঁর যাবতীয় সব। আর ছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু, রবীন্দ্রনাথ।

দুজনের বয়সের খুব বেশি তফাৎ ছিল না। সেখান থেকেই বন্ধুত্বের শুরু। শুধু ‘নতুন বউঠান’ই নন, রবি’র কাছে কাদম্বরী ছিলেন তাঁর লেখার সবচেয়ে বড়ো সমালোচক। আর সেটাই ভেতরে ভেতরে অনুপ্রেরণা দিয়ে যেত তাঁকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর কাদম্বরীর কাছেই যেন নিজের সবটুকু মেলে দিতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ। সে জোড়াসাঁকোই হোক, বা চন্দননগরের মোরান সাহেবের বাগানবাড়ি। তাঁর প্রিয় ‘হেকেটি’ একদিকে ছিলেন বন্ধু, অন্যদিকে অভিভাবকও। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীরও বিশেষ প্রিয় ছিলেন কাদম্বরী। সেটা অবশ্যই তাঁর সাহিত্যের প্রতি অসম্ভব অনুরাগের জন্য।

কাদম্বরী ও ঠাকুরবাড়ির গল্প অনেকেরই জানা। সব জায়গাতেই মূল ব্যাপার একটাই, নিঃসঙ্গতা। একাকিত্ব। হ্যাঁ, এতকিছু থাকতেও ভেতরে ভেতরে যেন অন্য দ্বীপের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। অবশ্য বিয়ের মুহূর্ত থেকেই কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ির একটা বড়ো অংশের কাছে ছিলেন ব্রাত্য। তাঁর বাবা ছিলেন জোড়াসাঁকোর সামান্য একজন কর্মচারী। তাঁর মেয়েকেই কিনা তখনও পর্যন্ত দেবেন্দ্রনাথের সবচেয়ে উজ্জ্বল পুত্রটির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া! কিছুতেই মানতে পারেননি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। শুধু তিনিই নন, অনেকেই একপ্রকার দূরে সরিয়ে রাখতেন কাদম্বরীকে। অবহেলা, অপমান ছিল নিত্যসঙ্গী।

তার ওপর ঘটে দুর্ঘটনা। স্বর্ণকুমারী দেবীর ছোটো মেয়ে ঊর্মিলা ছিল কাদম্বরীর ন্যাওটা। একদিন মুহূর্তের বেখেয়ালে ঊর্মিলা একা একা বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। তারপর সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়। বাঁচানো যায়নি তাকে। সবার সমস্ত রাগ এসে পড়ে কাদম্বরীর ওপর। সব দোষ যেন তাঁর। একে কোনো সন্তান হয়নি, অন্যের সন্তানও রাখতে পারল না— এমন কথাও শুনতে হয়েছিল তাঁকে। সমস্ত কিছু নিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন কাদম্বরী। কফিনে শেষ পেরেকটা পোঁতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ। নাটক আর জাহাজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। বাড়ি আসার সময়ই পান না। তার ওপর রবীন্দ্রনাথেরও বিয়ে হয়ে যায়। কাদম্বরী চেয়েছিলেন, নতুন বউ মৃণালিনীকে রবি’র মতো করে তৈরি করে দেবেন। কিন্তু সেটাও পারলেন না; বলা ভালো করতে দেওয়া হল না। শেষ পর্যন্ত ‘সরোজিনী’ জাহাজ উদ্বোধনে পরিবারের সবার সঙ্গে যাবেন বলে উদগ্রীব হয়েছিলেন। সেটাও না হওয়ায়, ধৈর্যের সব তার ছিঁড়ে যায়। অতঃপর, মাত্রাধিক আফিম সেবন এবং…

ঠাকুরবাড়ির পুত্রবধূর আত্মহত্যা— এই খবর তখনকার দিনে কী মারাত্মক আকার নিতে পারত তা বিলক্ষণ জানতেন সবাই। অবশ্য কাদম্বরী দেবী ১৯ এপ্রিলই মারা যাননি। ‘সরোজিনী’ জাহাজ থেকে তড়িঘড়ি সবাই ফেরার পর দেখেন, তখনও দেহে স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। চিকিৎসা শুরু হলেও, সেসব ছিল বৃথা। ঠিক দুদিন পর, মারা যান কাদম্বরী দেবী। আর বিয়ে করেননি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সমস্ত ঔজ্জ্বল্যও নিভে আসে…

কিন্তু সেই সময় ঠাকুরবাড়ি, বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথের ভূমিকা নিয়ে পরবর্তীতে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। শোনা যায়, কাদম্বরী দেবী একটি চিঠি লিখেছিলেন মৃত্যুর আগে। দেহ উদ্ধারের পর সেটাও পাওয়া যায়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে সেসব পুড়িয়ে ফেলা হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে পাঠানো কোনো এক নটীর চিঠিও পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির সমস্ত সদস্যরা অস্বাভাবিক রকমের নীরব ছিলেন এই মৃত্যুর পর। কোনো পোস্টমর্টেম হয়নি; সব আয়োজন, ডেথ রিপোর্ট হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে বসেই, দেবেন্দ্রনাথের সামনে। এমনকি, কোনো খবরের কাগজে যাতে এই খবর না প্রকাশিত হয়, সেই ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। রীতিমতো ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করান সাংবাদিকদের। এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তখনকার সংবাদপত্রের কোথাও এই নিয়ে সামান্য লাইনও লেখা নেই।

এভাবেই কেটে যায় ইতিহাস। ২৫ বছরের জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে অবহেলায়, নিঃসঙ্গে। সঙ্গী বলতে ছিলেন শুধু রবীন্দ্রনাথ। তাঁর লেখাই কাদম্বরী দেবীর জীবনকে সবচেয়ে ভালো ব্যক্ত করে। নতুন বউঠান যে কী ছিলেন তাঁর কাছে, এটা যে একমাত্র রবিই জানেন। বাস্তবিকই, ‘কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই’…

ঋণ-
১) ‘প্রথম আলো’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২) রোর বাংলা

More From Author See More