‘আত্মহত্যা মহাপাপ’, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার যে নিদান বারবার দিয়েছে ধর্মগ্রন্থগুলি

প্রতি বৃহস্পতিবার বাঙালি বাড়িতে একটি রীতি বরাবর হয়ে এসেছে। লক্ষ্মী ঠাকরুনের ঘটটি নতুনভাবে সজ্জিত করে, ফুল-বেলপাতা সহযোগে তাঁর আরাধনা। ঠাকুরের আসনটি ভরে ওঠে ধূপের গন্ধে। সকাল সকাল স্নান সেরে মা-ঠাকুমারা এসে বসতেন লক্ষ্মীদেবী আর তাঁর নতুন ঘটটির সামনে। দুলে দুলে পড়তেন পাঁচালি। গ্রামের মাটির বাড়ি আজ বদলে গেছে হাইরাইজে; কিন্তু বাংলার সনাতন এই ধারা বদলায়নি। শুনতে শুনতে আজও অনেকের কণ্ঠস্থ হয়ে যায় শব্দগুলি। সেই লক্ষ্মীর পাঁচালিরই একটি লাইন অনেককেই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। ‘আত্মহত্যা মহাপাপ, নরকে গমন’। নিজেই পরিপূর্ণ প্রবাদ হয়ে থেকে গেছে বাক্যটি। যার আড়ালে লুকিয়ে আছে অসহায়, মৃত্যুর পথে হাঁটা লাগানো মানুষটির উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী।

আত্মহত্যা— শব্দটি কারোর কাছে ভয়ের, আতঙ্কের; আবার কারোর কাছে মুক্তির পথ। চারিদিকের পরিস্থিতি যখন একজনকে ক্রমশ পিষে ফেলছে, তখন সে ক্রমাগত বাঁচার চেষ্টা করতে থাকে। পিছিয়ে যেতে যেতে একসময় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। তারপরও ক্ষতবিক্ষত হলে? কখনও গলায় দড়ির গাঢ় ফাঁসের দাগ, নয়তো রেললাইনের পাশে ছিন্নভিন্ন দেহ নিয়ে মুক্তির পথ খোঁজা। একজন মানুষ ঠিক কোন পর্যায়ে গেলে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবে! ‘আত্মহত্যা’ শব্দটির সঙ্গে ‘হত্যা’ যে কথাটিও জুড়ে আছে। এভাবে হেরে গেলে কি সবার জন্য ভালো হয়? 

এমন প্রশ্ন আত্মহত্যার আগে ওই মানুষটির মাথাতেও হয়তো আসে। কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। লেখার শুরুতে বলা হয়েছে লক্ষ্মীর পাঁচালির কথা। হিন্দু ধর্মের একটি লোকায়ত ধারা এটি। সেখানেও আত্মহত্যার বিপক্ষে কথা বলা হয়েছে। যে সর্বশক্তিমানের আরাধনা করো সবসময়, তোমার মৃত্যু কিন্তু তাঁকে খুশি করে না! তবে শুধু কি একটাই জায়গা? একটু ঘুরলে দেখা যাবে, ধর্মের সমস্ত জায়গাতেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করার কথা বলা হয়েছে। নিজের ‘কর্মের’ জন্য দুঃখ একসময় সবার জীবনেই আসবে। কিন্তু ‘মেঘ দেখে তুই করিসনে ভয়/ আড়ালে তার সূর্য হাসে’। সংসারের সেই দুঃখের মেঘ সরিয়ে খুশির রোদও ঝিলিক দিয়ে উঠবে। বৌদ্ধ ধর্মও এমনটা বলে গেছে বরাবর। পাশাপাশি জৈন ধর্মে আত্মহত্যা হল ‘হিংসা’র সবথেকে চরম পর্যায়। অহিংসা যে দুই ধর্মের পরম মন্ত্র, তারা এমন কাজকে কখনও প্রশ্রয় দেয়নি। 

ঈশ্বর একটা মানুষের জীবনকে খুব সাবধানে তৈরি করেন। সেই জীবনটা তাঁরই দান। কাজেই তাঁকে শেষ করে দেওয়া মানে সেই ঈশ্বরকে অবমাননা করা— বাইবেলের ভেতরে ঘুরে বেরালে এমন কথাই উঠে আসে। “Thou shalt not kill”! ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট— দুজনের কাছেই আত্মহত্যা মহাপাপ। যিশু যেখানে সমস্ত দুঃখ কষ্টের পরিত্রাতা হিসেবে আছেন সেখানে কীসের চিন্তা? এতে আসল ‘মুক্তি’ তো হয় না! এবার প্রশ্ন আসতে পারে, খোদ বাইবেলেই তো এমন বেশ কিছু চরিত্র আছে যারা সুইসাইড করেছে। উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে জুডাসের কথা, আহিতোফেলের কথা। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বাইবেলে যে কজন আত্মহত্যা করেছেন, তাঁরা সবাই ‘ভিলেন’। তাঁদের কর্মফলের জন্যই এমন শাস্তি ভোগ করেছেন— এই কথাই যেন ফুটে ওঠে সেই চরিত্রায়নের মধ্যে দিয়ে। 

সব ধর্মের সঙ্গে অবশ্যই আসবে ইসলাম ধর্মের কথাও। কোরান শরীফ কিন্তু সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ’র ওপরেই সবাইকে ভরসা রাখতে বলেছেন। খ্রিস্টধর্মের মতোই সুর এখানেও প্রতিধ্বনিত হয়। আল্লাহ দয়াময়; তাই তোমার দুঃখ তিনিই মোচন করবেন। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মধ্যে তো সমাধান নেই! বরং সেই সর্বশক্তিমান পয়গম্বরকেই অসম্মান করা। হাদিথে আবু হুরাইয়ার মুখ দিয়েই বেরিয়েছে আল্লাহের বাণী, যে-ই আত্মহত্যার মতো পাপ কাজ করবে তাকে নরকের আগুনের মধ্যে আজীবন থাকতে হবে। 

সমস্ত বিভেদ, হিংসা ভুলে প্রতিটা ধর্মের গভীরে গিয়ে দেখলে মানবতার কথাই উঠে আসে। তারই এক অঙ্গ হল আত্মহত্যা প্রতিরোধ। যে মানুষটা বাঁচার আশা হারিয়েছে, তাঁর মনের জানলা খুলে দেওয়া। আর কেউ থাকুক বা না থাকুক, ঈশ্বর নামের এক আদি অনন্ত শক্তি সবসময় তাঁর সঙ্গে আছে। তাঁকে একটু ভরসা করুক। যাতে দিনের শেষে আবার আনন্দ করে নিঃশ্বাস নিতে পারে মানুষটি। যাতে একটু বাঁচে— এটাই তো চাওয়া! আজকের এই কঠিন পরিস্থিতিতে এই চাওয়াই হোক সকলের পথ।  

আরও পড়ুন
দক্ষ শাসক হবেন সু-অভিনেতা, উপেক্ষা করতে হবে লোকনিন্দাও - মহাভারতের শিক্ষা এমনই

Powered by Froala Editor

More From Author See More