প্রবল অর্থাভাব, তবু ছাড়বেন না বাংলা; বম্বের ডাক ফেরালেন ‘চিত্রনাট্যকার’ তারাশঙ্কর

তখন সবে মুক্তি পেয়েছে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমাটি। নির্মল দে’র পরিচালনায় অত্যন্ত জনপ্রিয় জায়গায় পৌঁছে গেল ছবিটি। পরিচালক থেমে থাকলেন না; ঠিক করলেন নতুন একটি সিনেমা তৈরি করবেন। গল্পও ঠিক করে ফেললেন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁপাডাঙার বউ’। যথারীতি চলে গেলেন তারাশঙ্করের কাছে। তিনি তখন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। তাঁর গল্প তুলে এনেছে গ্রামবাংলার কথা। তিনি ঠিক করলেন, এই ছবির চিত্রনাট্যটি লিখবেন। সঙ্গে গানের কথাও যত্ন নিয়ে লিখলেন। এবার সেই কথায় সুর বসানোর পালা। পরিচালক নির্মল দে’র মনে বহু আগে থেকেই একটি নাম ঘোরাফেরা করছে। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তখন গান গেয়েছেন বটে, কিন্তু সঙ্গীত পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এই ছবির জন্য নির্মলবাবু ঠিক করলেন মানবেন্দ্রের নাম। কিন্তু সেটাই সবকিছু না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় যেহেতু কাহিনীকার, তাই তাঁকে একবার শুনিয়ে নিলে বোধহয় ভালোই হত। এদিকে সেই শোনানোর কাজটা এমন অসম্ভব জায়গায় যাবে সেটা কে জানত!

তারাশঙ্করের কথায়, সবই তো বোঝা গেল কিন্তু তিনি নিজে পরীক্ষা করে দেখবেন সুরকারের ক্ষমতা। তারপর কথা দেবেন। যথারীতি নির্মল দে’র সঙ্গে পরীক্ষাকেন্দ্রে, অর্থাৎ টালা পার্কে সাহিত্যিকের বাসস্থানে চলে গেলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। প্রথমে সব চুপচাপ। তারপর জানিয়ে দিলেন গান যেন জুতসই হওয়া চাই। চিরকুটে কয়েক লাইন লিখে মানবেন্দ্রকে দিলেন তারাশঙ্কর, বুঝিয়ে দিলেন সিচুয়েশন। একটু সময় নিয়ে গেয়ে উঠলেন তিনি। খানিক পরেই দেখলেন, কাহিনীকারের মুখে হাসি। মানবেন্দ্র বুঝলেন, পরীক্ষায় পাশ করে গেছেন তিনি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি আশ্রিত সিনেমাটির হাত ধরেই সুরকার হিসেবে যাত্রা শুরু করলেন তিনি… 

তারাশঙ্করের কথা বললেই পরপর ভেসে আসবে ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’, ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর মতো একের পর এক উপন্যাস। এর বাইরে আরও বেশ কিছু সত্তা তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। কখনও তিনি গীতিকারের আসনে, কখনও কাহিনিকার, আবার কখনও সাংবাদিক। গানের কাছে জীবনের নানা সময় ফিরতে চেয়েছেন তিনি। যখন দিনের পর দিন লেখা আসত না, সংসারে অভাব, জীবন যেন ভেঙে পড়া জাহাজের মতো হয়ে যাচ্ছে; সেই সময়ই ফিরে গেছেন রবীন্দ্রনাথের গানে। পরে যখন নিজে গীতিকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন, তখন সেই আবর্ত, সেই যাত্রাই ঘুরে ফিরে এসেছে। 

কত গল্প বেড়ে উঠেছিল মানুষটাকে ঘিরে। সুধীন দাশগুপ্ত বাংলা সিনেমার জগতে এক কিংবদন্তি নাম। তাঁরই সঙ্গে বেড়ে উঠছিলেন আরেকজন, মান্না দে। তখন নেহাতই তরুণ তিনি। ‘ডাক হরকরা’ ছবির জন্য গান গাইতে ডাকলেন সুধীন দাশগুপ্ত। এই ছবির জন্য কাহিনিকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি অসাধারণ গান লিখেছিলেন, ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি’। সুধীনবাবু ঠিক করলেন, মান্না দে-কে দিয়ে গাওয়াবেন এই গানটা। যথা সময় রেকর্ডিং হল সেই গান। তারপর শুনলেন স্বয়ং গীতিকার। মান্না দে’র গলায় গানটি শুনে কোনো কথা বলতে পারেননি তারাশঙ্কর। সবাই দেখেন, অঝোরে কেঁদে চলেছেন তিনি… 

একটা সময় বম্বে থেকেও ডাক এসেছিল তাঁর কাছে। হিমাংশু রায় ডাক পাঠিয়ে বলেছিলেন, তাঁর একজন বাঙালি চিত্রনাট্যকার প্রয়োজন। তারাশঙ্কর যদি যান, তাহলে খুবই ভালো হয়। মাসে মাসে ভালো মাইনে, বছর গেলে বেতনবৃদ্ধি। তারাশঙ্করের জীবনের এমন মোড়ে ডাকটি এসেছিল, যখন তাঁর সংসার অর্থের অভাবে ধুঁকছে। শত কষ্ট, শত প্রলোভন খারিজ করে দিয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। টাকার জন্য, চাকরির জন্য তিনি সর্বস্ব খোয়াতে পারবেন না। নিজের লেখা, নিজের লাভপুর, বীরভূম, কলকাতা এবং সর্বোপরি বাংলা ছেড়ে যাবেন না। পরবর্তীকালে অনেক টাকা রোজগার করেছেন এই বাংলার বুকে দাঁড়িয়েই। একের পর এক ছবিতে গান লিখেছেন, সেটা এই বাংলাতে দাঁড়িয়েই। 

শুধু কি গান? তাঁর নিজের উপন্যাস, ছোটগল্প পর্দায় জীবন্ত রূপ পেয়েছে। সে দেবকী বসু’র ‘কবি’, অজয় করের ‘সপ্তপদী’ই হোক, বা তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’। ‘সপ্তপদী’ কি বাঙালি দর্শক এত সহজে ভুলতে পারবে? তারাশঙ্করের কাহিনি, অজয় করের পরিচালনা; সেইসঙ্গে চিরকালীন জুটি উত্তম-সুচিত্রার অভিনয়। ‘এই পথ যদি না শেষ’ হওয়ার গল্প তো আজও মোহিত করে রেখেছে অনেককে। আর এসবের সঙ্গে উপস্থিত হবেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জলসাঘর’ নিয়ে অনেক গল্প তো সোশ্যাল দুনিয়ায় প্রচলিত। তারাশঙ্কর যে রাজবাড়িটিকে দেখে গল্পটি লিখেছিলেন, সত্যজিৎ নাকি অজান্তে সেই বাড়িটিতেই সিনেমাটির শুটিং সম্পন্ন করেন! পরে জানতে পেরে উভয় পক্ষই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। সেইসঙ্গে ছিল ১৯৬২-র ‘অভিযান’। গাড়ি ক্রমশ এগিয়ে গিয়েছিল। যতই খ্যাতি আসুক না কেন, প্রাণের লাভপুরকে কখনও ভুলতে পারেননি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ভুলতে পারেননি বাংলাকেও। ভাগ্যিস বম্বে যেতে হয়নি তাঁকে! 

আরও পড়ুন
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে চ্যাপলিনের সিনেমা দেখেছেন ভানু, করেছেন গুপ্তচরের কাজও

Powered by Froala Editor

More From Author See More