অবসাদ কাটিয়ে উঠতেই হবে আমাদের, মৃত্যুতে এই বার্তাই কি দিলেন সুশান্ত?

২০২০ সাল। হয়ত বিগত কয়েক শতাব্দীতেও বিশ্বজুড়ে এমন অভিশপ্ত বছর আর আসেনি। সেই অভিশাপের ধুলো ঢেকে দিচ্ছে আকাশ। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী কিছু বছর মানুষ তার আদিমতম অবস্থার সঙ্গে পরিচিত হবে, এর ফলে এই সময়ের ট্রানজিশন পর্ব বাড়িয়ে দেবে ডিপ্রেশন। বান্দ্রার সুবিশাল ফ্ল্যাটের চোদ্দ তলায় সুশান্ত একা একা যখন নিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তাঁর কোটি কোটি ভক্তের কেউ নেই চারপাশে, ক্যামেরার ঝলসানি নেই, ডিরেক্টরের চিৎকার নেই, মেকআপ আর্টিস্টের ব্যস্ততা নেই - রয়েছে অপার শান্তি। সেই শান্তির খোঁজে পালাতে  পালাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাঁর। ছিছোরে-তে যখন সুইসাইডের বিপক্ষে বলছিলেন তখন কী আদৌ তিনি অভিনেতা? কোনটা জীবন আর কোনটা অভিনয় সেটুকু বুঝতেই কারও একটা জীবন লেগে যায়। দেশের মধ্যে ৭ র‍্যাঙ্ক করা ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র সুশান্ত। ন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ফিজিক্সে দুরন্ত রেজাল্ট - রোলার কোস্টার জীবনে প্রতিভার স্ফূরণকে একাডেমিক থেকে একার চেষ্টাতেই বিনোদন জগতে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সিনেমা-গ্ল্যামার-বলিউডের মাদকতার মধ্যে সুশান্ত সিং কোথাও গিয়ে নিজেই হয়তো বোঝেননি তিনি একা হয়ে যাচ্ছেন।

মাত্র ৩৪ বছর বয়স। চূড়ান্ত সিনেমাজগতের সাফল্য, সফল ব্যবসায়ী, উচ্চশিক্ষা সবটুকু ছিল তাঁর। আড্ডা মারতে যার জুড়ি ছিল না কোনোদিন। এই পজিটিভ ছেলেটাই দিল্লির ইঞ্জিনিয়ার থেকে মুম্বাইয়ের তারকা। লাখ লাখ মেয়ের নয়নের মণি। তবে কী হল?

এর উত্তর আমরা জানতে পারব না। আমরা যারা ক্রমশ প্রতিদিন পাশাপাশি বসে টেলিফোনে কথা বলি, আমরা যারা বাস্তুভিটার দালান ভেঙে গড়ে নিচ্ছি নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, কার্পেট এরিয়ার মার্বেল আর ছাদের মাঝখানের জায়গাটাকেই বাড়ি বলে ভেবে নিয়েছি, যারা স্কুলকলেজের ধুলোমাখা বিকেলগুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছি রেডিও এক্টিভ ডিভাইসের ভেতর- সেখানে কোত্থাও এই প্রশ্নের উত্তর নেই। 

কতদিন গলা ছেড়ে গান গায় না কেউ, কতদিন কাউকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা হয় না বোধ হয়, কতদিন ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে আমাদের শৈশব বলে উঠতে পারেনি - ‘একটা গল্প শোনাবে আজ?’, কতদিন দুই বন্ধু নিজেদের জীবন খোলেনি গল্পের ফাঁকে, কতদিন বৃষ্টির পর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ছলাৎ ছল জলে পা চুবিয়ে লাফাতে পারিনি...

আরও পড়ুন
৬ দিন আগেই আত্মহত্যা করেছিলেন সুশান্তের প্রাক্তন ম্যানেজার দিশা সালিয়ন

ডিপ্রেশনের বাংলা মনখারাপ কিনা সত্যিই জানি না। সুশান্তও জানতেন না সেই সব পেয়েছির দেশে কোথায় গিয়ে তিনি জীবনকেই আর ছুঁতে পারলেন না। খুব আবেগপ্রবণ হয়েই অনেকে আমার মতো ভাবছেন ধোনির জীবনে অভিনয় করার পরেও এত সহজে কেন হাল ছাড়লেন সুশান্ত? এর উত্তর হয় না। জীবনের ক্যালেন্ডারে আজ এবং আগামীর তারিখ কখন যে অন্ধকার হয়ে যায় তা বোঝা মানুষের কম্ম না। ধোনির জীবনের অবসাদ যেমন সুশান্ত ছুঁতে পারবেন না, তেমনি ঐ অন্ধকার ঘরটার কোত্থাও ওয়াংখেড়ের আলোর ঝলসানি নেই। আছে একটা স্তব্ধতার মধ্যে লিখে দেওয়া দীর্ঘশ্বাস। 

আরও পড়ুন
প্রেসিডেন্সিতে ‘রেকি করতে’ আচমকা ঢুকলেন সুশান্ত, আড্ডা জমালেন হোস্টেলের ঘরে বসে

ডিপ্রেশন। মনের অসুখ। চিরকাল আমরা অবহেলা করে আসি। এবার হয়ত বোঝার সময় এসেছে যে সব পাওয়ার পরেও একা হতে গেলে স্রেফ একটা ডিপ্রেশনই যথেষ্ট। 

আরও পড়ুন
প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত, মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা!

যেখানে সারাদিনের ব্যস্ততার পর কোথাও গিয়ে কাউকে আঁকড়ে ধরার জায়গা কমে আসছে আমাদের। সুশান্ত ধোনি নন, কাই পো চে-র ঈশান্ত নন, ছিছোঁড়ের আন্নি-ও নন - দিনশেষে তিনি এক অন্ধকারের ভেতর হারিয়ে যাওয়া সম্রাট যার দু-পাশের আলোর জৌলুস তাঁকে আর স্পর্শ করতে পারল না।

আরও পড়ুন
মারণ ক্যানসার কেড়ে নিয়েছে যেসব বলিউড তারকার প্রাণ

সুশান্ত চলে গেলেন। নিঃশব্দে। ডিপ্রেশন নামক অন্ধকার যে আমাদের সবাইকে ক্রমশ ঘিরে ফেলছে তার প্রমাণ থেকে গেল ১৪ তলার ঘরটায়। ডিপ্রেশন কাটানো মানেই শুক্রবার রাতের নাইট আউট না, ডিপ্রেশন কাটানো মানেই মদ গাঁজাতে ডুবে ভুলে থাকা নয়, ডিপ্রেশন মানেই তা থেকে পালানোর জন্য সিনেমা দেখা বা পার্টি করা নয়, ডিপ্রেশন মানে একটা অন্ধকার বাক্স যাকে যত্ন করে খুলতে হয়, যাকে ছুঁয়ে দেখতে হয়, যার থেকে পালাতে নেই কখনও। আমরা এটুকুই বুঝতে ভুল করি। সুশান্ত শিখিয়ে গেলেন, অন্তত শেষবার চেষ্টাটুকু করি, ঝলমলে রোদকে জাপটে ধরতে, অন্ধকারকে হারিয়ে দিতে সুশান্ত আবার ফিরে আসবেন, ওয়াংখেড়ের সেই শেষ ছয়টা মেরে যে আলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাটা বাকি রয়ে গেল এজীবনে।

আরও পড়ুন
ইরফানের পর ফের ইন্দ্রপতন বলিউডে, চলে গেলেন ঋষি কাপুর

আপনার সমস্ত যন্ত্রণা হালকা হোক, ভালো থাকবেন সুশান্ত সিং রাজপুত...

Powered by Froala Editor