প্রেসিডেন্সিতে ‘রেকি করতে’ আচমকা ঢুকলেন সুশান্ত, আড্ডা জমালেন হোস্টেলের ঘরে বসে

“অনিতেশ, এঁরা একটু কলেজ ঘুরে দেখবেন। সিনেমার জন্য। নিয়ে যাবে?” প্রেসিডেন্সির গেটের সামনে তখনও ছায়া বিছিয়ে বিরাট গাছটা দাঁড়িয়ে ছিল, পুরোনো গেটটা ছিল। সেই গেটের ওপরে লেখা ছিল ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ’। গেট দিয়ে ঢুকতেই বাঁ’হাতে একটা ঘর। সেখানে বেঞ্চিতে বসে পাপ্পুদা, সঞ্জয়-দা। আমাদের কলেজে অনেক রথী-মহারথীরাই আসতেন। কিন্তু তা’বলে একজন ‘বলিউড স্টার’ হুট করে ‘রেকি করতে’ চলে আসবেন ভাবিনি। ফলে বিস্ময়ের ধাক্কাটা খানিক জোরালো হয়েছিল।

কোন মাস মনে নেই, সালটা ২০১৩। কাগজে পড়েছিলাম দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দিতে ব্যোমকেশ করছেন। ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করবেন সুশান্ত সিংহ রাজপুত। ‘কাই পো চে’-র সুশান্তকে কার না ভালো লাগেনি! মাথায় টুপি, পরনে নীল টি-শার্ট। সঙ্গী একজন গাইড। প্রাথমিক ঘোর সামলে কয়েকজন ঘিরেও ধরেছে। তখনো সেলফির এত চল হয়নি। মোবাইল ক্যামেরাও এত ঝকঝকে নয়। তারই মধ্যে কয়েকটা ছবি উঠছে। সুশান্তের সঙ্গী দাড়িমুখ মানুষটি আমায় জিজ্ঞেস করছেন, “এখানে স্পোর্টস রুম আছে? যেখানে ক্যারাম বোর্ড-টোর্ড থাকে।” আমি সায় দিচ্ছি। সুশান্ত সঙ্গেসঙ্গেই মুচকি হেসে বলছেন, “জলদি লে চলিয়ে।”

এই আচমকা ভিজিটের খবর তখনও বিশেষ রাষ্ট্র হয়নি। ফলে, খুব একটা বাধা না পেরিয়েই ঢুকে পরা গেল ‘বয়েজ কমন রুম’-এ। ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি’ সিনেমায় এখানেই শ্যুট হয়েছিল অজিত আর ব্যোমকেশের সাক্ষাতের দৃশ্য। ব্যোমকেশ ক্যারাম খেলছে। অজিতের বাবা নিখোঁজ শুনে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলছে, হয় অন্য কারো সঙ্গে পালিয়েছেন বা মারা গেছেন। শুনে অজিত এক ঘুষি মারছে ব্যোমকেশের মুখে। সেই বিসিআরের চারপাশ দেখতে দেখতে সুশান্ত একটি কথাই জিজ্ঞেস করেছিলেন আমায়, “গত পঞ্চাশ বছরে এই ঘরের কিছুই বদলায়নি?”

প্রেসির গায়ে তখনও পুরোনো সময়টা লেপ্টে ছিল। মেন বিল্ডিং-এর তিনতলার কয়েকটা কোণ দেখে মাঠ। সেখান থেকে প্রান্তিক আর স্নেহাশিসের সঙ্গে হিন্দু হোস্টেলের ৪ নম্বর ওয়ার্ড। তারপর কফি হাউস। আমাকে ফোন করলেন সেই সঙ্গী ভদ্রলোক। কফি হাউসে মিনিট দশ। কফি হাউসের এযাবৎ ইতিহাস ভুল প্রমাণ করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ইনফিউশন এল। সেলেব্রিটিদের সঙ্গে বেশি গা-ঘেঁষাঘেঁষি করলে কলেজে নিন্দে রটবে। ফলে আমি দূরে দূরে রই। সুশান্ত যাওয়ার আগে একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে দেন। সেই হাসিতে স্টারডমের ছিঁটেফোঁটাও নেই...

আরও পড়ুন
প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত, মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা!

 

আরও পড়ুন
ইরফানের নামে গ্রামের নামকরণ, প্রয়াত অভিনেতাকে শ্রদ্ধার্ঘ মহারাষ্ট্রের গ্রামবাসীদের

শ্যুটিং হয়েছিল পরের বছর জানুয়ারিতে। সেই বয়েজ কমন রুম, তিনতলার ঘর, হিন্দু হোস্টেলের ৪ নং ওয়ার্ড আর কফি হাউস। প্রেসির কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীও অভিনয় করেছিল সেই ছবিতে। বয়েজ কমন রুমের সিনেই যেমন অভিনয় করেছিল অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র শুভ গাঙ্গুলী। শুভ আজ ফোনে বলছিল, সেদিন প্রমোদদা-র ক্যান্টিন থেকে ইডলি এসেছিল, সেটাই খেয়েছিলেন সুশান্ত। সেদিন রবিবার, তার আগেরদিন শ্যুট হয়েছিল হিন্দু হোস্টেলে। প্রান্তিকের খাটে বসে সুশান্ত আড্ডা দিয়েছেন। আর রবিবারে যখন প্রেসিতে শ্যুটিং চলছে, বিরাট বিরাট সব রিফ্লেক্টর আয়না, তখনই প্রমোদদার ক্যান্টিনের চাতালে বসে মিটিং করছিলাম আমরা অনেকে। তাতে প্রায় সবাই ‘বহিরাগত’। কী নিয়ে সেই মিটিং ছিল আজ মনে নেই। হয়তো ‘অর্ধেক আকাশ’ কিংবা কোনো একটি যৌথ মঞ্চের মিটিং ছিল। প্রেসিডেন্সি তখনও রুদ্ধদ্বার হয়ে ওঠেনি। বলিউডি পিরিয়ড ড্রামার শ্যুটিং আর এমন সামাজিক মঞ্চের মিটিং তাই অনায়াসে একইসঙ্গে চলত। কেউ বাধাও দিত না...

আরও পড়ুন
রাধাবিনোদ পালের চরিত্রে অভিনয় ইরফানের, যে বাঙালির কাছে আজও কৃতজ্ঞ জাপানিরা

 

আরও পড়ুন
ইরফানের পর ফের ইন্দ্রপতন বলিউডে, চলে গেলেন ঋষি কাপুর

বিগত ৭-৮ বছরে পৃথিবীটা দুদ্দাড় বদলেছে। প্রেসিডেন্সি কলেজটাই আর নেই, সেই গেট নেই, গেটের সামনে গাছটা নেই, প্রমোদদার ক্যান্টিন নেই। আজ শুনলাম, সুশান্তও ‘নেই’ হয়ে গেছেন। তাঁকে পরে আমার অভিনেতা হিসেবে আর ভালো লাগেনি। কাগজে প্রায়ই পড়তাম তাঁর নানা নিত্যনতুন সম্পর্কের খবর। রাধিকা আপ্তে বলেছিলেন, বলিউডের মোস্ট ওভার-রেটেড অভিনেতা। হয়তো সত্যি! হয়তো নয়। কেন নিজেকে শেষ করে দিলেন সুশান্ত? অর্থহীন স্টারডমের বিষাদ ঘিরে ধরছিল বলে? পালাতে চাইছিলেন? যেভাবে আমাদের যৌবন, তার গায়ে লেপ্টে থাকা রং-বেরঙের স্বপ্নগুলোও পালাচ্ছে ক্রমশ। ভো-কাট্টা হয়ে উড়ে যাচ্ছে... সেদিনের প্রেসিডেন্সি আর আজকের সুশান্ত, দু’জনেই যেন একই...

আরও পড়ুন
প্রত্যাখ্যান এসেছে বারবার, পেয়েছেন অর্ধেক পারিশ্রমিকও, তবু হাল ছাড়েননি ইরফান