স্পেনের (Spain) উত্তর দিকের ছোট্ট একটি পার্বত্য টিলার নিচে শুয়ে আছে একটি কবরস্থান। কয়েক হাজার কবরের শেষ আশ্রয়, খ্রিস্টানদের ক্রশ দিয়ে চিহ্নিত করা আছে প্রত্যেকটি। বাহারি রঙের ফুল আর ঘাসের আস্তরণে ঢেকেছে জায়গাটি, খেলা করে পাহাড়ি গাছপালা আর স্নিগ্ধ রৌদ্রের আলো-ছায়া। কিন্তু বছরের পর বছর কেউ আসে না এখানে। যেন মানুষ ভুলে গেছে তাদের অস্তিত্ব, তাদের স্মৃতি। নির্জন জনমানবহীন প্রান্তরে প্রায় পঞ্চাশ বছর কেটে গেল এভাবে। এরকম তো সচরাচর হয় না। অতি যত্নে সাজিয়ে রাখা হয় পবিত্র কবরস্থান। আত্মীয়ের মৃত্যুর দিনগুলিতে ঢেকে যায় ফুলের স্তবকে, ‘অল সোলস ডে’-তে বহু আয়োজনে পূর্বপুরুষদের জানানো হয় শ্রদ্ধা। ব্যতিক্রম শুধু স্পেনের ‘স্যাড হিল সেমেট্রি’ (Sad Hill Cemetery)।
কারণ, কয়েকশো কবরের তলায় শুয়ে নেই কোনো মৃতদেহ। পরিজনের শেষযাত্রার জন্য নয়, ‘স্যাড হিল’ বানানো হয়েছিল সিনেমার প্রয়োজনে। তাও সেটা ১৯৬৭ সালে। হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’-র কবরস্থানের দৃশ্য যারা দেখেছেন, তাদের কাছে অচেনা নয় স্থানটি। সিনেমাতেও এই নামই ছিল কবরস্থানটির। কামানের হাত থেকে বাঁচতে একটি চরিত্র উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার কবরের মধ্যে দিয়ে। এরকমভাবেই দৃশ্যটি তুলে ধরেছিলেন ইতালিয়ান পরিচালক ও প্রযোজক সার্জিও লিওন (Sergio Leone)। সিনেমাটির প্রেক্ষাপট ‘ওয়েস্টার্ন আমেরিকা’ হলেও প্রাকৃতিক সাদৃশ্যের জন্য বেছে নিয়েছিলেন স্পেনের এই অঞ্চলটি। কাছাকাছির মধ্যে বড়ো শহর বলতে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাস্তিয়া লিওন প্রদেশের বুর্জোস শহর। আর সবচেয়ে কাছের গ্রামও কম করে ৫ কিলোমিটার রাস্তা। তাই দেমান্দা পাহাড়ের নিরিবিলি আরলাঞ্জা উপত্যকাটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল সিনেমার ‘সেট’ হিসেবে।
১৯৬৬-র গ্রীষ্মে শুরু হল প্রস্তুতি। ৩০০ মিটার ব্যাসের বৃত্তাকার কবরস্থানে খোদাই করা হল পাঁচ হাজার কবর। যার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল হাজার খানেক স্প্যানিশ সৈনিক। যাদের রোজকার মজুরি ছিল ২৫০ পেসেতা বা দেড় পাউন্ড ডলার। তাদের দেখভাল করার জন্যও ছিল কয়েকজন অফিসার। তারা আবার দৈনিক মজুরি নিত ৯০০ পেসেতা। তাতেও সময়মতো কাজ শেষ হবে না বুঝতে পেরে লিওন সাহেব শরনাপন্ন হন স্পেনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির। যার নাম ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো। স্বৈরাচারী এই শাসকের হাতে কবরে নিদ্রা গেছেন বহু সাধারণ মানুষ। আপাতত, তিনিই আরো হাজার খানেক লোক পাঠালেন সিনেমার কবর খোঁড়ার জন্য।
নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল সিনেমার শুটিং। সকলে লোটকম্বল গুটিয়ে পাড়ি দিল দেশের পথে। শুধু সবুজ উপত্যকার বুকে পড়ে রইল পাঁচ হাজার শূন্য কবর। স্থানীয় লোকজনও খুব বেশি আসে না এখানে। এমনিতে প্রয়োজন পড়ে না, তাছাড়া কেই-বা অকারণে আসবে জনহীন কবরের দেশে। একটা সময়ের পর কারোর মনেই রইল না ‘স্যাড হিল সেমেট্রি’-র অস্তিত্ব। পাখিরা এসে বসে কাঠের ক্রশগুলিতে। মাঝে মাঝে গজিয়ে উঠল ছোটো গাছ। মানুষের ফেলে যাওয়া কবরে, নতুন ফুল ফোটাল প্রকৃতি। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরিত্যক্ত হয়ে রইল সেটি।
আরও পড়ুন
বাক্সবন্দি কবর শিশুর, ফিরে আসছে ভ্যাম্পায়ারের গল্প
অবশেষে ২০১৫ সালে ‘স্যাড হিল কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন’ শুরু করে কবরস্থান সন্ধানের কাজ। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে নয়, নিছকই সিনেমাপ্রেমী হিসেবে। সারা পৃথিবী যেখানে ইন্টারনেটের তালুতে বন্দি, সেখানে খুব বেশি দিন লাগেনি সঠিক জায়গার খোঁজ পেতে। নতুন করে সাজিয়ে তুলতে হবে স্থানটি, তার জন্য প্রয়োজন অর্থ। এক অদ্ভুত বুদ্ধি আবিষ্কার করল তারা। মাত্র ১৫ পাউন্ডের বিনিময়ে কেনা যাবে এক-একটি কবর। মৃত প্রিয় পরিজনের নাম খোদাই করা হবে কবরগুলিতে। ইউরোপ-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জুটল স্বেচ্ছাসেবীর দল। পাথরের চাঁই সরিয়ে, জংলা ঘাস কেটে সুদৃশ্য পর্যটনকেন্দ্রের মতো গড়ে তুলল ‘স্যাড হিল’-কে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গুইলেরমো দে ওলিভিয়েরা নামের এক স্প্যানিশ পরিচালক বানিয়ে ফেললেন একটি তথ্যচিত্র। খুঁজে বের করলেন কবরখনকদের উত্তরপ্রজন্মকে। সাক্ষাৎকার নিলেন স্থানীয় অধিবাসীদের। বিখ্যাত সুরকার এনিও মোরিকোনে কিংবা পরিচালক জো দান্তেও সঙ্গেও হল আলাপচারিতা।
আরও পড়ুন
সিনেমা দেখে অনুপ্রেরণা, ২৬ শিশুকে জ্যান্ত কবর, মার্কিন ইতিহাসের করুণ অধ্যায়
মূলত এই তথ্যসূত্রের জেরেই প্রাণ ফিরে পেল স্থানটি। বছরের বিভিন্ন সময়ে এখন পর্যটকদের ভিড়। দেখতে আসে সিনেমার ঐতিহাসিক সেট এবং পাঁচ হাজার শূন্য কবর। ‘স্যাড হিল’ এখন আর ততটাও ‘স্যাড’ নয়।
চিত্রঋণ : Santiago Lopez Pastor, Wikimedia Commons
Powered by Froala Editor