সত্যজিৎ-বিধানচন্দ্র, ‘পথের পাঁচালী’ ও কিছু প্রচলিত ভুল তথ্য

আজ ২৬ আগস্ট। 'পথের পাঁচালি' সিনেমার মুক্তির দিন। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পিছনে ভূমিকা ছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়েরও। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এবছর বারবার উঠে এসেছে সেই আলোচনা। পত্র পত্রিকায়, প্রবন্ধে এমনকি বিখ্যাত কিছু মানুষের লেখাতেও যে সব তথ্য এই বিষয়ে উঠে আসে, তাঁদের সারসংক্ষেপ এই রকম - 

১। বিধান রায় সংস্কৃতির ধার ধারতেন না। তাঁর কোন আইডিয়াই ছিল না সত্যজিৎ কী বানাতে যাচ্ছেন, বা বানিয়েছেন। এই ধারণার পিছনে আছেন দুইজন নামকরা সত্যজিৎ জীবনীকার। মারি সেটন লিখছেন, বিধান রায় নাকি ছিলেন "a man with no pronounced love of art and no knowledge of film as an expressive medium.” অ্যান্ড্রু রবিনসন এককাঠি এগিয়ে বিধান রায় সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত বই ‘ইনার আই’তে লিখেছেন “from the beginning, misunderstood the film’s nature, seeing it as a documentary."

২। সিনেমার টাকা দেওয়া হয়েছিল পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের টাকা থেকে, কারণ সরকার নাকি সিনেমার নাম দেখে ভেবেছিলেন এটা রাস্তা বানানোর ডকুমেন্টরি ধরনের কিছু হবে।

৩। বিধান রায়ের ছবির শেষের করুণ পরিণতি অপছন্দ হওয়াতে তিনি সেটা বদলে দিতে বলেন। শুধু তাই না, দুর্গাকে নাকি বাঁচিয়েও দিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ নিজের গোঁ ধরে রাখেন। বাকিটা ইতিহাস।

৪। সরকার সত্যজিতকে পরিচালনা বাবদ কোনো টাকা দেয়নি। শুধু বানানোর অন্য খরচা দিয়েছিল।

৫। সরকারি আধিকারিকরা নাকি বারবার বলেছিলেন এ-ছবির প্রযোজনা না করতে। কিন্তু সত্যজিতের অসামান্য প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ডাক্তার রায় তাঁদের কথা নস্যাৎ করে দেন। 

সব কটা ভুল কথা। নানা তথ্য এবং সত্যজিতের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ইত্যাদি খুঁটিয়ে পড়লেই আসল সত্য উঠে আসে। সত্যজিৎ বিশেষজ্ঞ ছন্দক সেনগুপ্ত মহাশয়ও একবার এই নিয়ে লিখেছিলেন, কিন্তু এই মিথ এত জবরদস্ত, যে সেই জগদ্দলকে ঠেলে ফেলা মুশকিল। 

একে একে আসি। 

সত্যজিৎ রায়ের ছবি করা উচিৎ কি উচিৎ না এই নিয়ে বিধান রায়-কে যারা উপদেশ দেন, তাঁদের মধ্যে যে পি এস মাথুর ছিলেন (যিনি বারবার বলেছিলেন এই ছবি না করতে) তেমন ছিলেন মন্মথ রায়। এই মন্মথ রায় কালের কালবৈশাখীতে চাপা পড়ে গেছেন, কিন্তু তিনি না থাকলে পথের পাঁচালী আদৌ আলোর মুখ দেখত কিনা সন্দেহ। এই ভদ্রলোক ছিলেন বিখ্যাত নাট্যকার, সিগনেটের সত্যজিতের প্রচ্ছদের ভক্ত, আর বিভূতিভূষণের একনিষ্ঠ পাঠক। সিনেমার রাফ কাট দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। সিনেমা বা চিত্রনাট্য তিনি খুব একটা বুঝতেন না, তবুও তাঁর রিপোর্টে তিনি পরিষ্কার লেখেন "বিভূতিভূষণের উপন্যাসের প্রকৃতি যেন ছবিতে অবিকল রূপ পেয়েছে। আমি অভিভূত। আমার দেখে মনে হল এক মহান পরিচালক যেন তাঁর জীবনের সেরা মাস্টারপিসটি বানাতে চলেছেন।" মনে রাখতে হবে, এটা তিনি যখন লিখছেন তখন ছবির গোটাটা বানানোই হয়নি। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তো দূরের কথা। কিন্তু মাথুরের রিপোর্ট ছিল এর ঠিক বিপরীতে। ফলে বল চলে আসে সরাসরি বিধান রায়ের কোর্টে যার কিনা "সিনেমা নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না!" 

বিধান রায় আর পঙ্কজ মল্লিক মিলে ছবির রাফ কাট দেখলেন। হ্যাঁ, বিধান রায় নিজে রাফ কাট দেখেছিলেন। পঙ্কজ মল্লিক পরে স্বীকার করেন তিনি নিজেও ছবি নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন না। কিন্তু এই রাফকাট দেখেই বিধানবাবু উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, বোঝেন এই ছবির মেরিট আছে আর সরসরি মন্মথবাবুর উপদেশটাই মেনে নেন। রবিনসনের কথা তাই কতটা ভুল ভেবে দেখুন।

এবার ছবির টাকার কথা। ছবির টাকা আদৌ পি ডব্লু ডি থেকে আসেনি। এসেছিল লোকরঞ্জন শাখা থেকে। সত্যজিৎ নিজে ফোক ইসাকসনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এ-কথা। ‘মাই ইয়ারস উইথ অপু’-তে সত্যজিৎ জানাচ্ছেন তাঁর মায়ের বন্ধু বেলা সেন আর তাঁর মেয়ে অর্চনার সঙ্গে তিনি যখন বিধান রায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান, বিধান রায় বলেন শেষটা একটু করুণ হয়ে যাচ্ছে না? তখন সত্যজিতের আগেই অর্চনা প্রতিবাদ জানিয়ে বলে “The ending is too well-known and very moving. There would be objections from the readers of the novel as well as from [the author’s] family if the ending was changed in any way.” ফলে আলোচনা সেখানেই শেষ। সত্যজিতের গোঁ ধরার প্রয়োজনই হয়নি।

সিনেমার বাজেট ছিল ৭০০০০ টাকা, আর যে-কোনো সরকারি প্রজেক্টের মতো এটাতেও পরিচালকের টাকা ধরা ছিল, যেটা সেদিনের হিসেবে নেহাত কম না। ৩০০০ টাকা। ইসাকসনকেও সত্যজিৎ বলেছেন "since I was taking a very small salary", ফলে এই সিনেমায় সত্যজিতকে বিধান রায় এবং তাঁর সরকার একেবারে কিচ্ছু দেননি, এটাও ভুল কথা। যেটা সত্যজিৎ চেয়েও পাননি, সেটা হল ফরেন রাইট। আর সেখানে তাঁকে কিছুটা অন্ধকারে রেখেই সই সাবুদ করানো হয়। বিস্তারিত জানার জন্য ইসাকসনের সাক্ষাৎকারটি পড়ে দেখার অনুরোধ করছি, কিন্তু তাতে ডাক্তার রায়ের কোনো হাত ছিল না। আর, কান উৎসবে ছবিটা দেখানো হলেও সরকার সেখানে সত্যজিৎ-কে পাঠায়নি।

তাহলে এই ডকুমেন্টারির কথা কার মাথায় এল? বিধান রায় তো ভাবেননি। ভাবলেও অর্চনা দেবীর সঙ্গে আলোচনায় তাঁর সন্দেহ দূর হবার কথা। আসলে এই ধারণা হয়েছিল পশ্চিমা কিছু চিত্র সমালোচকের। তাঁর মধ্যে বসলে ক্রোথার-ও ছিলেন। তাঁরা শুরুতে ছবিটা ধরতেই পারেননি। নিজের সমালোচনায় এত বার বাংলার গ্রাম নিয়ে তথ্যচিত্র শব্দবন্ধ লিখে গেছেন যে তাঁদের পরে পশ্চিমা যাঁরাই লিখেছেন এই ধারণা থেকে বেরোতে পারেননি। তাঁদের মনে হয়েছে পশ্চিমের মতো এদেশেও বুঝি এই সিনেমাকে সবাই ডিকুমেন্টারিই ভেবেছিল। আদৌ তা না।

বাংলা সিনেমার ইতিহাসের বাঁক বদলে দিয়েছিল যে সিনেমা, তার সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো দূর করা আজ খুবই জরুরি। এই বিকৃত আলোচনায় দুই কিংবদন্তির কেউই খুশই হতেন না। 
তথ্য- ছন্দক সেনগুপ্ত, মাই ইয়ারস উইথ অপু, ইন্টারভিউস- সত্যজিৎ রায় (সম্পাদক- বার্ট কৌডিলো)

Powered by Froala Editor