প্রয়াত শবরদের দিনবদলের পথিকৃৎ নন্দলাল শবর, শোকস্তব্ধ পুরুলিয়া

আর্থিক-সামাজিক বৈষম্যের বেড়াজাল। অস্পৃশ্যতা। এসবের মধ্যে থেকেই বঞ্চিত অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল একটা লড়াই। পিছিয়ে পড়া শবর সম্প্রদায়ের জন্য সেই কঠিনতম সংগ্রামের পথেই নেমেছিলেন তিনি। অসচেতন জনজাতিকে একত্রিত করেছিলেন নন্দলাল শবর। গত পরশু ভোরে চলে গেলেন এই কিংবদন্তি। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।

প্রাচীন ভারতের জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম শবর জনজাতি। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই জনজাতি মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর হাত ধরে। লেখায় বার বার এসেছে তাঁদের যাপনচিত্রের ছাপ। তবে তার অনেকআগে থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছিলেন নন্দলালবাবু।

১৯৬৮ সালে পুরুলিয়ার কুদা গ্রামে নন্দলালবাবু-সহ শবর জনগোষ্ঠীরই সাত সদস্যকে নিয়েই তৈরি হয় খেড়িয়া-শবর কল্যাণ সমিতি। রাজনওয়াগড়ের রাজা গোপীবল্লভ সিংদেও-র তত্ত্বাবধানে গঠিত সেই সমিতিতে ছিলেন দেওরাং অঞ্চলের জনৈক ব্যক্তি মদন রায়ও।

শবররা মূলত যাযাবর জীবনযাপন করতেন দীর্ঘ সময়। ব্রিটিশ শাসনকালে ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন স্থানেই স্থায়ী বসতি স্থাপন করছিলেন শবররা। তবে অস্পৃশ্যতা তো ভারতের গায়ে লেগেই ছিল বহু আগে থেকে। শবরদেরও সম্মুখীন হতে হল সেই সমস্যার। পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারও শবরদের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছিল ‘অপরাধপ্রবণ জনজাতি’-র তকমা। ফলে সামাজিক নির্যাতনেরও শিকার হতে থাকলেন তাঁরা। আজকের সমাজেও যা অব্যহত। গ্রামের এক কোণে বসবাস তাঁদের। ফলে অন্যান্য জনজাতিদের সঙ্গে ছিল না যোগাযোগও। জানা ছিল না চাষাবাদের ব্যবহার। বনভূমির ওপরেই নির্ভরশীল অন্নসংস্থান।


এমন পরিস্থিতিতে, নন্দলালবাবুর হাত ধরেই শুরু হয় জমিতে কৃষিকাজ। বাড়িতে হাঁস, মুরগি, ছাগলের মতো পশুপালনেও ধীরে ধীরে অভ্যস্থ হতে লাগলেন শবররা। শুধু চাষাবাদে আগ্রহ জোগানোই নয়, বরং নিজে হাতে কুদা গ্রামের শবরদের কৃষিকাজ শিখিয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রভাবেই আজ অন্যান্য শবরগ্রামগুলির থেকে অনেকটাই এগিয়ে কুদা। এখন গেলে মরশুমি চাষও দেখা যাবে সেখানে। অব্যবহৃত জমি প্রায় নেই বললেই চলে।

আরও পড়ুন
প্রয়াত ভারতীয় বায়ুসেনার প্রথম মহিলা কমান্ডার বিজয়লক্ষ্মী রামানন

তবে শুধু কৃষিকাজে আধুনিকতা এলেই কি এগিয়ে যাবে একটা জনজাতি? না। দরকার শিক্ষারও। সেদিক থেকেও শবরদের নতুন পথ দেখালেন নন্দলালবাবু। স্কুলে যাওয়ার প্রেরণাও এল তাঁর কাছ থেকেই। নন্দলালবাবুর ছেলে নির্মল শবর, শবর সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে প্রথম স্নাতক হয়ে তৈরি করলেন আরও এক দৃষ্টান্ত। বাবার থেকে লড়াইয়ের ব্যাটন নিলেন নিজের হাতে।

শবরদের নিয়ে বর্তমানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে আরও এক সংস্থা, 'শবর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট'। এই ট্রাস্টের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিকভাবে যুক্ত ছিলেন নন্দলাল শবর। গত বছরই ট্রাস্টের উদ্যোগে চালু হয়েছিল একটি আবাসিক স্কুলবাড়ি। 'স্বপ্নের স্কুলবাড়ি'-র পথচলাও শুরু হয়েছিল নন্দলালবাবুর হাত ধরেই। নিজের সরকারি স্কুলের চাকরির পরেও এই স্কুলবাড়ির পিছনেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাঁর ছেলে নির্মল শবর।

আরও পড়ুন
প্রয়াত বাচিকশিল্পী প্রদীপ ঘোষ, সংস্কৃতিমহলে শোকের ছায়া

শবর সম্প্রদায়ের স্নাতক শ্রেণীতে পাঠ্যরত ছাত্রছাত্রীদের দিয়েই প্রাথমিক স্তরের পড়ুয়াদের শিক্ষাদানের একটি পরিকল্পনাও চলছিল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের। সম্প্রতি সেই পরিকল্পনার নীল-নকসা বানাতে কুদা গ্রামে আয়োজিত হয়েছিল একটি বৈঠকও। ট্রাস্টের অন্যতম সদস্যা দেবাঞ্জলি ভট্টাচার্য জানালেন, "গত ১১ তারিখের মিটিংয়েও পুরোটা সময়ই মন দিয়ে আলোচনা শুনেছেন নন্দলাল জ্যেঠু। মন্তব্য করেছেন এই পরিকল্পনার ব্যাপারে। তবে এতটুকুও বুঝতে দেননি নিজের অসুস্থতার কথা।"

ট্রাস্টের আরেক সদস্য নীলেশ মজুমদারের কথায়, "কুদা গ্রামে আমাদের এই উদ্যোগ কখনোই সম্ভব হত না, যদি না নির্মলদা থাকতেন। সমস্তটাই সারামাস ধরে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করেন নির্মলদা। স্কুলে পড়ানো থেকে শুরু করে গ্রামের বিভিন্ন প্রকল্প। সবটাই। নন্দলাল জ্যেঠু আমাদের থেকে যেহেতু অনেকটাই আগের প্রজন্ম, তাই ওঁর লড়াই-এর বিষয়ে গল্প শুনলেও সামনাসামনি তা প্রত্যক্ষ করিনি। তবে নির্মলদাকে সবসময়ই দেখছি। নন্দলাল জ্যেঠু না থাকলে একজন নির্মলদা তৈরি হতে পারত না কোনোদিনই।"

বলতে গেলে নন্দলাল শবর কুদা গ্রামের এক চলমান ইতিহাস। শুরু থেকেই সমস্ত যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে আছেন যিনি, শবর সম্প্রদায়ের এই জাগরণের পথিকৃৎ হয়ে। উল্লেখ্য, শবর কল্যাণ সমিতির প্রবীণতম জীবিত ব্যক্তি ছিলেন তিনিই। গোটা শবর সম্প্রদায় এবং তাঁদের সঙ্গে জুড়ে থাকা সমস্ত মানুষদের কাছে ছিলেন একজন অভিভাবক। ফাঁকা হয়ে গেল সেই জায়গাটাই। রয়ে গেল তাঁর দেখানো পথ। এখনও হাঁটা বাকি বহুদূর। তাঁর স্মরণে শবর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট স্বপ্নের স্কুলবাড়ির জন্য খুলতে চলেছে একটি লাইব্রেরি। কিংবদন্তির চলে যাওয়ায় কোনোভাবেই মুষড়ে পড়ছেন না বাকিরা। বরং প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাকি যুদ্ধটা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়ে যাওয়ার জন্য।

আরও পড়ুন
আদিবাসীদের দাবি মেনে ঐতিহ্যে বদল, এবার দশেরায় কাটা পড়বে না একটিও গাছ

Powered by Froala Editor

More From Author See More