সংস্কৃতে ভালো নম্বর পাওয়ায় ব্যঙ্গও শুনতে হয়েছিল ভারতের প্রথম আদিবাসী মহিলা উপাচার্যকে

কিছুদিন আগের ঘটনা। সিধো-কানহো-মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে নিযুক্ত হলেন সোনাঝারিয়া মিনজ। সেই সঙ্গে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকল ভারত। স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভারতের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী অধ্যাপিকা ভার গ্রহণ করলেন উপাচার্যের।

সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদ ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ এসবের বৈষম্য মুছে দিয়েছে স্বাধীনতার সময়ই। তবে শুধুমাত্র ছাপা হরফেই রয়ে গেছে কথাগুলো। এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে, স্বাধীনতার তিয়াত্তর বছর পরও আমরা বৈষম্য পেরোতে পেরেছি কি আদৌ? সাম্যাধিকার স্রেফ কল্পকথা হয়েই রয়ে গেছে এই যুগেও।

সংখ্যালঘু হওয়ার দরুণ অপমান, হেনস্থা, অপব্যবহারের শিকার হতে হয় এখনও। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, হরিয়ানার অনেক অঞ্চলে এখনো প্রচলিত রয়েছে অস্পৃশ্যতা। আশ্চর্যের বিষয় উত্তরোত্তর বাড়ছে এই আগ্রাসন। এর কারণ হিসাবে অশিক্ষাকে চিহ্নিত করা ভুল হবে। কেননা শুধু প্রান্তিক সমাজে না, এই মানসিকতার ছাপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও সুস্পষ্ট। স্কুল-কলেজগুলোর কথা নয় বাদই দেওয়া গেল। দিল্লির জওহরলাল নেহরু থেকে বাংলার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, এমন তাবড় প্রতিষ্ঠানেও জাতিভেদের শিকার হয়েছেন একাধিক সংখ্যালঘু অধ্যাপিক-অধ্যাপিকা। আদিবাসী অধ্যাপিকার ক্লাস করতে না চেয়ে সরব হওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল কলকাতায়। কাজেই বর্ণবিদ্বেষ শুধুই অশিক্ষা না, কোথাও গিয়ে মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।

ঝাড়খণ্ডের গুমলা জেলার আদিবাসী এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করায় লড়াইটা তাই সহজ ছিল না সোনাঝারিয়া মিনজের। সামাজিক প্রতিকূলতা নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল তাঁর। শিক্ষার্থী থেকে অধ্যাপিকা হওয়া ওঠার সময়টায় অক্লান্তভাবেই তাঁকে যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে। আদিবাসী হওয়ায় রাঁচির এক ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মেলেনি।

স্কুলে পড়ার সময় প্রথম হেনস্থা হতে হয়েছিল উচ্চবর্ণের শিক্ষকের কাছে। তখন বোধগম্য না হলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা। উচ্চবিদ্যালয়ে সংস্কৃত পরীক্ষায় ভালো নম্বর আসাতেও শিক্ষকের তীর্যক মন্তব্য বিঁধেছিল তাঁকে। ‘আর্যদের এই ভাষা’ কীভাবে তিনি আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন, তা নিয়েই ঠাট্টা করেছিলেন সেই শিক্ষক। আদিবাসী হওয়ায় যেন তাঁর কোনো অধিকার নেই কোনো ভাষার শেখার। গণিতের শিক্ষক একাধিকবার মন্ত্রণা দিয়েছিলেন জীববিদ্যা নিয়ে পড়ার জন্য। তিনবার একশো শতাংশ নম্বর পাওয়ার পরেও ব্যঙ্গাত্মকভাবে তাঁকে সাবধান করেছিলেন, গণিতকে স্নাতকস্তরের বিষয় হিসাবে বেছে নিলে অসুবিধায় পড়তে হবে তাঁকে। এই মন্তব্যগুলো যে কতটা অপমানসূচক, একজন শিক্ষকের কাছে এই বোধটুকুর অভাব আশ্চর্য করে! সত্যিই কি অভাব? নাকি জাতিদম্ভ তাঁকে এটা শিখিয়েছে যে, একজন সংখ্যালঘুর সঙ্গে এমনটা করাই যায়? তবে শুধু শিক্ষকদের কাছে না, সহপাঠীদের কাছেও নানান সময়ে অপদস্ত হতে হত তাঁকে। 

বাধ্য হয়েই বর্ণবিদ্বেষ থেকে মুক্তি পেতে সপরিবারে দক্ষিণ ভারতে চলে যান তাঁর বাবা। সেখানে গণিত নিয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শুরু করেন মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজে। পরে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তী কালে এম.ফিল এবং গবেষণা সম্পূর্ণ করার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। তবে তার আগেও শিক্ষকতা করেছেন ভোপালের বরকাতুল্লাহ এবং মাদুরাইয়ের কামারাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তবে জাতিভেদের পাশাপাশি মহিলা হওয়ায় লিঙ্গ বৈষম্যে তাঁর পথ সংকীর্ণ ছিল আরও। তাই নিজে শিকার হলেও বরাবরই আগলে রাখতে চেয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের। অধ্যাপনার সময় একাধিকবার ছাত্রদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই অংশ নিয়েছিলেন প্রতিবাদে। ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার, সাম্যের জন্য এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন বারবার। 

এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, এই বিদ্বেষের উৎস আসলে কোথায়? একটু ভাবলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে ব্যাপারটা। ছোটোবেলায় কোনো শিশু সেটাই শিখবে, যেটা পরিবেশটা তার পরিবার বা শিক্ষক তৈরি করে দেবে তার চারিদিকে। এই পরিবেশটাই তাকে হয় দাম্ভিক করে তুলবে, নয় মানবিক। সোনাঝারিয়া মিনজের বাবা ছিলেন লুথেরান বিশপ নির্মল মিনজ। তিনিও দীর্ঘকাল লড়ে গেছেন সাম্যবাদ আর আদিবাসী অধিকার নিয়ে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাঁচি গসনার কলেজের। আদিবাসী সংস্কৃতি এবং ভাষাগুলির শিক্ষাদান করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওঁরাও উপজাতির কুদুখ ভাষার উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। এখনও ঠিক এই লক্ষ্য নিয়েই কাজে নেমেছেন সোনাঝারিয়া মিনজ। বৈষম্যের ঊর্ধ্বে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত একটা আকাশ তৈরি করাই তাঁর উদ্দেশ্য। উপাচার্যের পদাসীন হয়ে সিধো-কানহো-মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয়কে আদিবাসী সংস্কৃতির এবং বহু-বৈষয়িক শিক্ষাঙ্গন করে তোলাই তাঁর পাখির চোখ এখন। লক্ষ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহেলিত আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের পঠন-পাঠনের পীঠস্থান করে তোলা।

সোনাঝারিয়া মিনজ প্রমাণ করেছেন নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা দিয়েই কাজ করে গেলে জয় আসবেই। সমস্ত প্রতিকূলতাই তাঁর লড়াকু মানসিকতার কাছে মাথা ঝুঁকিয়েছে। হাজার হাজার উপেক্ষিত, বৈষম্যের শিকার হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সোনাঝারিয়া মিনজ একটি অনুপ্রেরণার নাম। তাঁর এই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই শুরু হচ্ছে ভারতের ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়। তবে যুদ্ধটা ওঁর একার নয়, পাশে  আছেন সারা ভারতের আরো সাড়ে তেত্রিশ হাজার আদিবাসী শিক্ষক-শিক্ষিকা ও মুক্তচিন্তকরা। সেইসঙ্গে এই লড়াইয়ের দায়ভার আমাদের প্রত্যেকেরও। আমাদের সকলেরই দায়িত্ব বিষম্যহীন সেই পরিবেশটা গড়ে তোলার অংশ হয়ে ওঠা।


Powered by Froala Editor

More From Author See More