পাহাড়ের ওপর পাতা হবে রেললাইন, ‘নেটিভ’ শ্রমিকদের ওপর অকথ্য নির্যাতন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের

একসময় রেলগাড়ি ছিল ভারতবর্ষের নতুন অতিথি। এই অতিথিকে নিয়ে দেশবাসীর আগ্রহ ছিল প্রচুর। তবে ব্রিটিশদের কাছে তা ছিল নিছক ব্যবসার জিনিস। ভারতে রেলগাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে কিন্তু বহু রক্ত ঝরানো ইতিহাস জড়িয়ে। তেমনই এক ইতিহাসের সাক্ষী পুনে-বোম্বাই রেলওয়ে পথ। ভারতবর্ষে এমন অনেক জিনিস ছিল, ব্রিটিশদের কাছে যা সোনার চেয়েও দামি। পশ্চিম ভারতের উপকূল জুড়ে তেমনই ছিল তুলোর চাষ। তুলোকে তখন তারা 'সাদা সোনা' বলেও ডাকত। কিন্তু এই 'সাদা সোনা'র বাণিজ্যের সামনে মূর্তিমান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ভোর ঘাট। ঘাট অর্থে স্থানীয় ভাষায় পাহাড়। তবে অপ্রতিরোধ্য ইংরেজ বণিকদের সামনে মাউন্ট এভারেস্টও কোন বাধা হতে পারে না। বাস্তবেও হয়নি। আর সেই পাহাড়জয়ের ইতিহাস আজ বিস্মৃতপ্রায়।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। মারাঠাদের একাধিক যুদ্ধে পরাজিত করে পশ্চিম উপকূলে তখন ইংরেজদের একচেটিয়া আধিপত্য। আর ডেকান অঞ্চলের তুলোর চাষই তাদের হাতছানি দিয়ে ডেকে এনেছিল। কিন্তু সেই তুলো রপ্তানি করতে গেলে তাকে বোম্বাই বন্দরে নিয়ে আসতে হবে। আর তাহলে রেললাইন পাততে হবে ভোর ঘাটের উপর দিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে তখনও এমন নজির মেলে না। ১৮৫২ সাল। ঐতিহাসিক এই কাজের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার জেমস জোন বার্কলে। ইতিমধ্যে তিনি বোম্বাই থেকে থানে রেললাইন পাতার কাজের দায়িত্বে। কিন্তু পাহাড়ের উপর দিয়ে রেললাইন পাতার কাজে সাফল্য পেলে যে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে। কিন্তু তিনি বোধহয় তখন জানতেন না, কী কী চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য।

পরের চার বছর ধরে চলল সমীক্ষার কাজ। তৈরি হল ৩০০০ ম্যাপ, অজস্র রেখাচিত্র, ক্রস সেকশন। সমীক্ষার রিপোর্ট দেখে অনেকেই বললেন, এই কাজ অসম্ভব। মাত্র ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে উঠতে হবে ২০১৭ ফুট। স্টিম ইঞ্জিনের পক্ষে এই ঢাল অতিক্রম করা অসম্ভব। তবে হাল ছাড়ার পাত্র নন বার্কলে। পাহাড়ের ঢাল দিয়ে ঘুরিয়ে লাইন পাতার পরিকল্পনা নেওয়া হল। দূরত্ব খানিকটা বাড়ল, তবে অসম্ভবকে সম্ভব তো করা হল!। 

পরিকল্পনা হল ২৫টা টানেলের, ৮টা খাঁজকাটা রাস্তা। রেললাইন পাততে কাটা হবে ৫৪ মিলিয়ন বর্গফুট পাথর। আর এই কাজের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন কয়েক হাজার শ্রমিক। হবে নাই বা কেন? তখন না আছে ডিনামাইট, না আছে কিছু। পাথর কাটতে গেলে লেগে পড়তে হবে হাতুড়ি-গাঁথনি নিয়ে।

কাজ শুরু হল ১৮৫৬ সালে। এইবার বার্কলে পড়লেন আরেক সমস্যায়। ভারতীয় শ্রমিকদের কাজের ধরন সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাও ছিল না। শ্রমিকদের সঙ্গে কথায় কথায় লাগল ঝামেলা। বার্কলের শরীরে যে ব্রিটিশের নীল রক্ত। শুরু করলেন অকথ্য অত্যাচার। আর তার মধ্যেই এসে গেল মহাবিদ্রোহ। বিদ্রোহে সামিল হলেন বার্কলের অধঃস্তন শ্রমিকরাও। তার মধ্যে আবার মহামারী। ম্যালেরিয়া আর কলেরার প্রকোপ পড়লেন শ্রমিকরা। তবে এসবের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে দুর্ঘটনায়। খাড়া পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করার কাজ তো সহজ নয়। তার উপর শ্রমিকরা প্রত্যেকেই এ কাজে অপটু। পাহাড়ে টানেল কাটার কাজ করতে হতো দড়িতে ঝুলে। দড়ি থেকে পড়েই মৃত্যু হয়েছে কতজনের।

১৮৫৯ সাল নাগাদ কাজ অর্ধেকও শেষ হয়নি। মূলধন নিয়েও চলেছে টানাটানি। সবকিছু সামলে কাজ শেষ হতে লেগে গেছে আরও তিন চার বছর। ১৮৬৩ সালের ২১ এপ্রিল উদ্বোধন হল এই রেলপথ। ঐতিহাসিক এই রেললাইনের উপর দিয়ে ছুটে গেল ডেকান ক্যুইন। ব্রিটিশ ভারতে শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমনই কত ঘটনা। কত অত্যাচার, নিপীড়ন। সেই রক্তাক্ত পথ দিয়েই তৈরি হয়েছে আধুনিক ভারতের ইতিহাস। এই কাহিনি তো শুধু ইংরেজদের অত্যাচারের কাহিনি নয়। আসলে দেশের নবযুগের রথ টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন এইসব শ্রমিকরা। আমরা তাঁদের আর কতটুকুই বা মনে রেখেছি?

একসময় রেলগাড়ি ছিল ভারতবর্ষের নতুন অতিথি। এই অতিথিকে নিয়ে দেশবাসীর আগ্রহ ছিল প্রচুর। তবে ব্রিটিশদের কাছে তা ছিল নিছক ব্যবসার জিনিস। ভারতে রেলগাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে কিন্তু বহু রক্ত ঝরানো ইতিহাস জড়িয়ে। তেমনই এক ইতিহাসের সাক্ষী পুনে-বোম্বাই রেলওয়ে পথ। ভারতবর্ষে এমন অনেক জিনিস ছিল, ব্রিটিশদের কাছে যা সোনার চেয়েও দামি। পশ্চিম ভারতের উপকূল জুড়ে তেমনই ছিল তুলোর চাষ। তুলোকে তখন তারা 'সাদা সোনা' বলেও ডাকত। কিন্তু এই 'সাদা সোনা'র বাণিজ্যের সামনে মূর্তিমান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ভোর ঘাট। ঘাট অর্থে স্থানীয় ভাষায় পাহাড়। তবে অপ্রতিরোধ্য ইংরেজ বণিকদের সামনে মাউন্ট এভারেস্টও কোন বাধা হতে পারে না। বাস্তবেও হয়নি। আর সেই পাহাড়জয়ের ইতিহাস আজ বিস্মৃতপ্রায়।

Powered by Froala Editor

More From Author See More