আদতে ভিনগ্রহী ছিলেন হিমালয়ের রহস্যময় ‘দ্রোপা’ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা?

তিরিশের দশকের শেষের দিক সেটা। বিশ্বযুদ্ধের আবহেই তখন মেতে রয়েছে গোটা পৃথিবী। এমন সময় দক্ষিণ এশিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল আশ্চর্য এক আবিষ্কার। চিন ও তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত বায়ান-কারা-উলা পর্বতের এক গুহার অদ্ভুত এক সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে পান একদল প্রত্নতাত্ত্বিক, অবশ্য ‘এক্সপ্লোলার’ হিসাবেই নিজেদের পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন তাঁরা। কিন্তু হিমালয়ের এই দুর্গম স্থানে কীভাবে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সভ্যতা? এই প্রাচীন মানুষরাই বা কারা? 

উত্তরটা শুনলে একটু ঘাবড়ে যেতে হবে বইকি। এই সভ্যতার নেপথ্যে রয়েছে ‘ড্রোপা’ (Dropa Tribe) নামের এক রহস্যময় জনগোষ্ঠী। অবশ্য জনগোষ্ঠী বলা উচিত হবে কিনা, তা তর্কসাপেক্ষ। কারণ মানুষ নয়, বরং দ্রোপরা ছিল আদতে ভিনগ্রহী। হ্যাঁ, এমনটাই জানিয়েছিল তৎকালীন গবেষণা। কিন্তু পৃথিবীর বুকে কীভাবে এসে হাজির হয়েছিল তারা? কেনই বা পৃথিবীতে স্থায়ী বসতি নির্মাণ করেছিল এলিয়েনরা? 

শুরু থেকেই বলা যাক এই গল্প। ডঃ চি পু তেই-এর নেতৃত্বে ‘এক্সপ্লোরার’-রা যে সভ্যতার নিদর্শন পেয়েছিলেন, তা অবস্থিত তিব্বতের অতি দুর্গম এক অঞ্চলে। প্রথমত, বিশেষ পোশাক এবং থাকার বন্দোবস্ত ছাড়া হিমশীতল এই অঞ্চলে কোনো মানুষের পক্ষেই থাকা সম্ভব নয়। এমনটাই মনে করেছিলেন তাঁরা। দ্বিতীয়ত, যে জিনিসটা তাঁদের সবচেয়ে ভাবিয়ে তুলেছিল তা হল গুহার মধ্যে লুকিয়ে থাকা গোপন-কক্ষ। সিলিন্ডারের আকৃতির এই কক্ষগুলি আদতে ছিল কবরস্থান। আর সেগুলি খুলেই রীতিমতো চমকে যান অনুসন্ধানকারীরা। 

সবমিলিয়ে প্রায় ৭টি মৃতদেহের সন্ধান পেয়েছিলেন তাঁরা। প্রতিটির দৈর্ঘ্যই বড়োজোর এক মিটারের একটু বেশি। অর্থাৎ, আধুনিক মানুষের থেকে বেশ খানিকটা বামন তারা। পাশাপাশি তাদের মাথার খুলি ছিল শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিকরকম বড়ো। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল, কবরগুলির মধ্যে লুকিয়ে থাকা কিছু পাথরের চাকতি। ৩০ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট ও ৮ মিলিমিটার পুরু পাথরগুলিতে অজানা একটি ভাষায় খোদাই করা ছিল এক অদ্ভুত শিলালিপি। ডানদিক থেকে বাঁদিক বা বাঁদিক থেকে ডানদিক নয়, এই ভাষা লেখা হয়েছিল চক্রাকার বা সর্পিলভাবে। 

আরও পড়ুন
এলিয়েন-অনুসন্ধানের পথপ্রদর্শক, প্রয়াত কিংবদন্তি ফ্র্যাঙ্ক ড্রেক

সবমিলিয়ে সে-সময় উদ্ধার হয়েছিল প্রায় সাতশোর বেশি চাকতি। তবে পরবর্তী পঁচিশ বছরে অধিকাংশ শিলালেখই হারিয়ে যায়। যেগুলি অবশিষ্ট ছিল, তার ওপর ভিত্তি করেই গবেষণা শুরু করেন বেজিং অ্যাকেডেমি অফ সায়েন্সের অধ্যাপক ডঃ সুম উম নুই। তাঁর কথায় এই বিশেষ ভাষার সঙ্গে আংশিকভাবে মিল রয়েছে প্রাচীন চৈনিক এবং হায়ারোগ্লিফিক অক্ষরের। ১৯৬২ সালে এই ভাষা অংশিকভাবে করতেও সক্ষম হয়েছেন বলেই দাবি করেন তিনি। যদিও চিনে নয়, বরং ষাটের দশকের শেষলগ্নে সেই অনুবাদ প্রকাশিত হয় এক সোভিয়েত পত্রিকায়। সত্তরের দশকে অ্যাসোসিয়েট প্রেস-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও জায়গা করে নিয়েছিল এই প্রাচীন শিলালিপি। 

আরও পড়ুন
চাকরি পেলেন ‘পুরোহিত’, এলিয়েন অনুসন্ধানে আশ্চর্য পদক্ষেপ নাসার!

অনুবাদ অনুযায়ী, এই রহস্যময় জনগোষ্ঠীর নাম দ্রোপা। ১২ হাজার বছর আগে আকাশ থেকে খসে পড়েছিল তারা। অন্য এক গ্রহে যাত্রার সময় নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাদের মহাকাশযান। ফলে, বাধ্য হয়েই পৃথিবীতে জায়গা নেয় দ্রোপারা। ধীরে ধীরে হিমালয়ের চরম পরিবেশেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল তারা। সেইমতো অভিযোজনও হয়েছিল তাদের। হিমালয়ের বুকেই গড়ে ওঠে তাদের আস্ত এক বসতি। তবে সমান্তরালভাবে মানব সভ্যতার বিকাশে তাদের সঙ্গে সংঘাত বাঁধে স্থানীয়দের। শারীরিক গঠনগত বিভেদের কারণে নির্বিচারে তাদের শিকার করা শুরু করে মানুষ। 

আরও পড়ুন
১৭১৫টি বসবাসযোগ্য গ্রহ থেকে দৃশ্যমান পৃথিবী, ইঙ্গিত ভিনগ্রহীদের দিকেই?

কমিউনিজমের সঙ্গে দ্রোপাদের এই গল্প খাপ খায় না কোনোভাবেই। ফলে, এই অদ্ভুত গল্প তৈরির করার শাস্তিস্বরূপ পিকিং অ্যাকাডেমিস থেকে রাতারাতি বহিষ্কার করা হয় ডঃ সুম উম নুইকে। মাস কয়েকের মধ্যেই জাপানে নির্বাসিত হন তিনি। তবে দ্রোপাদের সন্ধান থেমে থাকেনি। সোভিয়েত গবেষক ভি জাইৎসেভের হাতেও পৌঁছেছিল গুটি কয়েক পাথরের চাকতি। সেগুলি পরীক্ষা করে তিনি জানান, পাথরের চাকতিগুলি নাকি অনেকটা ম্যাগনেটিক ডিস্কের মতো। সেগুলি বিদ্যুৎ পরিবহনে সক্ষম। তবে আদৌ তাতে ভিনাইল বা ডিস্কের মতো কোনো তথ্য সংরক্ষিত আছে কিনা, তা উদ্ধার করতে পারেননি তিনি। নির্দিষ্ট সময় পর সেগুলি তাঁকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল চিনের প্রশাসনের কাছে। কিন্তু আজকের প্রযুক্তির জগতে দাঁড়িয়েও কি তাদের রহস্য সমাধানের কোনো উপায় নেই মানুষের কাছে? 

না, প্রযুক্তির সুবিধা থাকলেও, সেই রহস্যময় চাকতিগুলোই আর অবশিষ্ট নেই কোথাও। ১৯৬৮ সালের কথা। এক অস্ট্রিয়ার সংবাদকর্মী শেষবারের জন্য চিনের মিউজিয়ামে গিয়ে ছবি তুলেছিলেন এই চাকতিগুলির। সেই ছবি প্রকাশ্যে আসার কিছুদিনের মধ্যেই জাদুঘর থেকে উধাও হয়ে যায় সেগুলি। এমনকি জাদুঘরের সমস্ত আর্কাইভ ও নথি থেকে মুছে ফেলা হয় ডঃ সুম উম নুই-এর নাম। অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধামাচাপা পড়ে যায় দ্রোপা-রহস্যও। তারা আদৌ কোনো উন্নত মানব সভ্যতার অংশ ছিলেন নাকি সত্যিই ভিনগ্রহী ছিলেন— সেই উত্তর আজও অজানা… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More