এলিয়েন-অনুসন্ধানের পথপ্রদর্শক, প্রয়াত কিংবদন্তি ফ্র্যাঙ্ক ড্রেক

সৌরজগতের পরিধির বাইরে মহাকাশ-জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নক্ষত্র। তাদের চারিদিকেও ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথক পৃথক গ্রহ-উপগ্রহ। হুবহু সৌর-পরিবারের মতোই। কিন্তু এই কোটি কোটি গ্রহের মধ্যে কি এমন কোনো গ্রহ নেই যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে পৃথিবীর মতোই? আজ নয়, বহু বছর আগে থেকেই মানুষের মনে বার বার উঁকি দিয়েছে এই প্রশ্ন। তৈরি হয়েছে গল্প, উপন্যাস, সিনেমা। খবরের কাগজ কিংবা সংবাদ মাধ্যমে ছেপেছে কনস্পিরেসি থিওরিও। কিন্তু ভিনগ্রহীরা আদৌ আছে কিনা, তা জোর গলায় গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন এক মার্কিন জ্যোতির্বিদ।

ফ্র্যাঙ্ক ড্রেক (Frank Drake)। ‘সেটি’ (SETI) অর্থাৎ ‘সার্চ ফর এক্সট্রাটেরিস্টিয়াল ইন্টেলিজেন্স’-এর জনক নামেই পরিচিত তিনি। এমনকি তাঁর তৈরি ‘ড্রেক ইক্যুয়েশন’ বা ‘ড্রেক সমীকরণ’ (Drake's Equation) আজও এলিয়েন হান্টারদের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র-সম। গত ২ সেপ্টেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাপ্টোসে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এই কিংবদন্তি মার্কিন গবেষক। বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।

ড্রেকের জন্ম ১৯৩০ সালে শিকাগোয়। আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগের কথা। হার্ভার্ড থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরিতে মহাকাশ পর্যবেক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন ড্রেক। বলতে গেলে, হাতের মুঠোয় সোনার পাথরবাটি পেয়েছিলেন তিনি। কিশোর বয়সেই তাঁকে টেলিস্কোপে মহাকাশ দেখতে শিখিয়েছিলেন তাঁর বাবা। গল্প শোনাতেন সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণরত গ্রহদের। অন্যদিকে কল্পনায় ভিনগ্রহীদের ছবি আঁকতেন ড্রেক। স্বপ্ন দেখতেন, একদিন ভিনগ্রহীদের সন্ধানে দূর নক্ষত্রে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। সেখানে দাঁড়িয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ যেন তাঁকে বাড়তি সুযোগ করে দেয় এই স্বপ্নপূরণের।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অবজারভেটরিতেই ছিল তৎকালীন সময়ের সবথেকে শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপ। যা ১২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কোনো নক্ষত্রে বার্তা প্রেরণে সক্ষম। না, সুযোগ হাতছাড়া করেননি ড্রেক। বরং, রুটিন কাজের ফাঁকেই শুরু হয় ভিনগ্রহীদের অনুসন্ধান। আর তিনি এই প্রকল্পের নাম দেন ‘প্রোজেক্ট ওজমা’। আসলে অন্যান্য এলিয়েন হান্টারদের মতো পৃথিবীতে এলিয়েনদের হানা দেওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকতে চাননি। বরং, নিজেই পৌঁছে যেতে চেয়েছিলেন ভিনগ্রহে। সেই বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জে রেডিও-বার্তা পাঠাতেন ড্রেক।

অবশ্য প্রাথমিকভাবে ড্রেকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়নি বিজ্ঞানীমহল। বরং, উপহাস্যের বিষয় হয়ে ওঠে প্রোজেক্ট ওজমা। সাফল্যের অভাবে কয়েকদিনের মধ্যে বন্ধও হয়ে যায় এই প্রকল্প। তবে হাল ছাড়েননি ড্রেক। ১৯৬১ সালে ‘সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্টিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘সেটি’-র সম্মেলনে গিয়ে নতুন পরিকল্পনা দানা বাঁধে তাঁর মনে। স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইন যে-সময় আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব প্রকাশ করেন, তখন এই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার কোনো উপায়ই ছিল না মানুষের কাছে। তা সত্ত্বেও কেবলমাত্র অঙ্কের মাধ্যমেই নিজের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আইনস্টাইন। তেমনটাই যদি করে দেখানো যায় এলিয়েনদের অস্তিত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও?

যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। শুরু হল, গাণিতিক উপায়ে ভিনগ্রহীদের অস্তিত্বের সম্ভাবনা নির্ণয়। মাস খানেকের মধ্যে আস্ত সমীকরণও বানিয়ে ফেলেন ড্রেক। ‘ড্রেকের সমীকরণ’ হিসাবেই যা পরিচিত আজ। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী কেলভিন মেলভিন, পিয়্যারম্যান-সহ একাধিক খ্যাতনামা গবেষকই সে-সময় সায় দিয়েছিলেন ড্রেকের এই প্রচেষ্টাকে। অবশ্য বিতর্কও কম হয়নি অবশ্য। তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছিলেন ‘সেটি’-র জনক। কিন্তু কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই সমীকরণ?

ব্রহ্মাণ্ডে নক্ষত্রের মোট সংখ্যা, তাদের জন্মহার, প্রাণধারণে সক্ষম সম্ভাব্য গ্রহের সংখ্যা-সহ বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই এই সমীকরণ বানান ড্রেক। আজ থেকে ৬০ বছর আগে দাঁড়িয়ে যা আজগুবি মনে হলেও, সাম্প্রতিক আবিষ্কার সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছে সেই ধারণাকে। এখনও পর্যন্ত সৌরজগতের বাইরের প্রায় ৩০ কোটি গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা। জানা গেছে, প্রতিটি নক্ষত্রের চারপাশেই নির্দিষ্ট দূরত্বে রয়েছে একটি বিশেষ প্রাণধারণে সক্ষম অঞ্চল। যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় পরিচিত হ্যাবিটেবল জোন নামে। এখনও পর্যন্ত প্রায় শতাধিক বেশি গ্রহ পাওয়া গেছে যাদের পরিবেশ বা আবহাওয়া পৃথিবীর মতোই। অর্থাৎ, যারা বিরাজ করছে কোনো না কোনো নক্ষত্রের হ্যাবিটেবল জোনে। ফলত, ড্রেকের সমীকরণ অনুযায়ী, ভিনগ্রহীদের অস্তিত্বের কথা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া চলে না। 

প্রথম বহির্জগতের গ্রহের সন্ধান পাওয়ার পরেই রীতিমতো সাড়া পড়ে যায় ড্রেকের সমীকরণ নিয়ে। ১৯৭৭ সালে নাসার ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২ মিশনেরও দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। পাশে ছিলেন আরেক কিংবদন্তি জ্যোতির্বিদ কার্ল সেগান। যথাক্রমে আগামী ২০২৫ ও ২০৩৪ সাল পর্যন্ত মহাবিশ্বে মানুষের রেকর্ড করা রেডিও বার্তা প্রেরণ করবে এই মহাকাশযান দুটি। 

না, এখনও পর্যন্ত মানুষের প্রেরিত বার্তার প্রত্যুত্তর মেলেনি কোনো। তবে চুপ করে বসে নেই ‘এলিয়েন হান্টার’-রাও। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা চলছে পুরোদমে। আর আজও তাঁদের কাছে দুর্মূল্য সম্পদ ড্রেকের এই সমীকরণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটাই বদলে গেছে মহাকাশ গবেষণার পরিধি। প্রযুক্তির দৌলতে সামনে এসেছে বহির্জগতের বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্রের চরিত্রও। ফলে, ড্রেকের সূত্রেরও বদল দরকার বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীদের একাংশ। ২০১৬ সালে ‘অ্যাস্ট্রোবায়োলজি’ বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ড্রেকের সমীকরণের একটি সংশোধিত সংস্করণ। কোনোরকম সমালোচনা না করেই, নিজের সমীকরণের এই সংশোধিত সংস্করণকে স্বাগত জানিয়েছিলেন প্রবীণ জ্যোতির্বিদ। যে গতিতে বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে, তাতে আর বছর কয়েকের মধ্যে ভিনগ্রহীদের অস্তিত্বের কথা প্রকাশ্যে এলে বা প্রমাণিত হলে, আশ্চর্য হওয়ার নেই কিছুই। তবে জীবিতাবস্থায় নিজের গবেষণার সেই সাফল্য দেখে যেতে পারলেন না ‘সেটির জনক’…

Powered by Froala Editor