কমছে হাতঘড়ির চাহিদা, দেশবিদেশের সম্ভার নিয়েও বিবর্ণ বাগবাজারের সাধুখাঁ ওয়াচ

অফিস যাওয়ার জন্য বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। অথবা তাড়াতাড়ি স্টেশনে পৌঁছতে হবে। সময় দেখার জন্য আর হাতের কব্জি উলটে দেখেন না কেউই। এখন মোবাইল স্ক্রিনেই সময় দেখে নেওয়া যায়। তবু সেই হাতঘড়ির নস্টালজিয়া এখনও ঝেরে ফেলতে পারেনি বাঙালি। আর ঝেরে ফেলতে পারেনি বলেই এখনও বাগবাজার স্ট্রিট আর গিরীশ অ্যাভেনিউর মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘সাধুখাঁ ওয়াচ’। অর্ধশতাব্দীর ধুলি-ধূসরতা গায়ে মেখে।

পুরোন দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকতেই খটকা লাগে। সামনে জেরক্স মেশিনে কাজ করছেন এক প্রৌঢ়। “আসলে এখন তো আর হাতঘড়ির তেমন চাহিদা নেই। তাই সবরকম ব্যবসাই করতে হয়।” বলছিলেন সুভাষ সাধুখাঁ। সেই সত্তরের দশকে বাবার হাত ধরে নতুন দোকানে আসা। তারপর থেকে এই দোকানেই কেটে গেল সমস্ত জীবন। শুধুই জেরক্স এবং প্রিন্ট-আউট নয়, কাঁচের শো-কেসে সাজানো আছে ব্যাটারি টর্চ, বাচ্চাদের খেলনা; নানাকিছু। তবু সবকিছুর মধ্যেই যেন একটা ফেলে আসা শৈশবের গন্ধ মাখা।

আর অবশ্যই আছে হাতঘড়ি। কাচের প্যানেলে পরপর সাজানো অসংখ্য ঘড়ি। হাল আমলের কিছু মডেল যেমন আছে, তেমনই আছে নানা পুরনো মডেল। “এখন তো হাতঘড়ি হয় উপহার দেয়, নাহলে ফ্যাশানের জন্য কেনে। কতদিন ঘড়ি চলল, সেসব দেখে কেউ?” অভিমানী সুভাষবাবু প্রশ্ন করেন। সেইসঙ্গে কিছুটা গর্ব মিশিয়ে বলেন, “আমাদের ঘড়ি হাসতে হাসতে ৫ বছর চলে যাবে।” হ্যাঁ, এই জীর্ণ দোকানেও ঘড়ির দাম অন্য জায়গার থেকে একটু বেশিই। ৮০-র দশক জুড়ে ভালো ঘড়ির ঠিকানা নামেই পরিচিত ছিল সাধুখাঁ ওয়াচ। দেশবিদেশের নানা নামী ব্র্যান্ডের ঘড়ি পাওয়া যেত সেখানে। আজও যায়। ক্যাসিও, সিটিজেন, ডিজেলের মতো ব্রান্ডের ঘড়ির প্রথম ঠিকানা সাধুখাঁ ওয়াচ।

“তবে ভালো জিনিসের চাহিদা কমছে।” বারবার একই আক্ষেপ সুভাষবাবুর। দোকানটা এখনও টিকে আছে শুধু ঘড়ি মেরামতির ব্যবসার উপর। এই অর্ধশতাব্দী ধরে তাঁরাই নিয়মিত ফিরে ফিরে আসেন। আর প্রতিবার সযত্নে মেরামত করে দেন সুভাষবাবু। “এখনকার সব হাতঘড়ি তো ইউজ অ্যান্ড থ্রো। পার্টস পাবেন কোথাও?” অবশ্য পুরনো মডেলের পার্টসও আর সেভাবে পাচ্ছেন না সুভাষবাবু। কোম্পানিরাও নতুন মডেল বানাচ্ছে। আজকের জেনারেশনের জন্য স্মার্ট ওয়াচ। শুধু উত্তর কলকাতার রাস্তায় ছোট্ট একটি দোকান ঐতিহ্যকে ধরে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সময় বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে দোকানের ভিতরের চেহারাও। শুধু প্রায় ৫০ বছর ধরে না বদলানো সাইন বোর্ডটা যেন বলছে, ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More