সেলুলারে প্রথম হরতাল

‘কালাপানি’ আন্দামান— ১৫
আগের পর্বে

কয়েদিদের প্রতিদিনের জন্য বরাদ্দ ছিল এক ডাব্বু করে ভাতের মাড় বা কাঞ্জি। তাঁদের চেহারা, ওজন ব্যতিরেকে খাবারের পরিমাণ সমান। পাশাপাশি রন্ধনে মানা হত না ন্যূনতম স্থাস্থ্যবিধি। সামান্য এই আহারাদি পেটে দিয়েই হাড় ভাঙা খাটুনি খাটতে হত রাজবন্দিদের। টানতে হত তেলের ঘানি কিংবা পেটাই করতে হত ছোবড়া। কাজে ঢিলে হলেই অপেক্ষা করত কঠিন শাস্তি। ঘানি ঘোরাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তেন অনেকেই। দাগি আসামীদের জন্য থাকলেও, রাজবন্দিদের জন্য কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না সেলুলার জেলে। তারপর…

নন্দগোপাল চোপরা পাঞ্জাবি ক্ষত্রিয়। দীর্ঘকায় সুপুরষ। এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক স্বরাজ্য পত্রিকাতে রাজদ্রোহী নিবন্ধ লেখার জন্য তাঁর দশ বছরের দ্বীপান্তরের সাজা হয়। তাঁকে যেদিন ঘানিতে যুক্ত করা হল, তিনি এক অভিনব কাণ্ড ঘটালেন। নন্দগোপাল প্রথমেই বললেন, “এত জোরে ঘানি ঘোরানো আমার পোষায় না।” ঘানি সাধ্যমত আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগিল। ফলে দশটার মধ্যে তেলের এক-তৃতীয়াংশ পেষা হল না। দশটার সময় নিচে এসে কয়েদিরা পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই কোনমতে চান সেরে, ভাত খেয়ে আবার কাজ করতে ছুটল। কারাগারের আইন অনুসারে দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত আহার ও বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট থাকলেও কাজ পাছে শেষ না হয় এই ভয়ে কেউ বিশ্রাম নিতে সাহস করে না। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হলে হাত-পা ছড়িয়ে একটু জিরাবার সুযোগ পায়। যে নন্দগোপাল সাংঘাতিক সব রাজদ্রোহী সম্পাদকীয় লিখে দণ্ড ভোগ করতে এসেছেন, তাঁর কীসের ভয়? সবাই যখন কাজ শেষ করার জন্য ছুটছে তখন নন্দগোপাল সবে তিন থেকে চার গ্রাস চিবিয়েছেন। পেটি অফিসার এসে তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবার জন্য তাঁর ওপর হুকুম জারি করল। ওয়ার্ডার চিৎকার করে বলল, “চলো, কাম তুমহারা বাপ করেগা? উঠো!”  নন্দগোপাল তাকে পাত্তা না দিয়ে মুখের মধ্যেকার গ্রাস চিবিয়ে যেতে লাগলেন। জেলার ব্যারী সাহেবের কাছে রিপোর্ট গেল।  তিনি এসে দেখলেন নন্দগোপাল “বত্রিশ দাঁতে চৌষট্টি কামড় মারিয়া এক এক গ্রাস গলাধঃকরণ করিতেছেন”। খুব খানিকটা তর্জন-গর্জন করে ব্যারী সাহেব নন্দগোপালকে বুঝিয়ে দিলেন যে কাজ যদি সে যথাসময়ে শেষ করতে না পারে তাহলে বেত্রাঘাত অনিবার্য। নন্দগোপাল নিতান্ত ভদ্রভাবে জেলার সাহেবকে মিষ্টি হেসে জানালেন যে, তিনি মোটেই এখানে সময় নষ্ট করছেন না, তিনি শুধুমাত্র তাঁর মুখের গ্রাস চিবোচ্ছেন। তিনি তার সাথে এও বললেন যে স্বাস্থ্যবিধি মতে সঠিক ভাবে খাবার চিবানোর ওপরেই হজমশক্তি নির্ভর করে। এবার ব্যারী সাহেব তাঁকে ভয় দেখালেন যে এখানে আইন ভাঙার ফল হবে মারাত্মক। তখন নন্দগোপাল ব্যারী সাহবকে কারাগার আইন সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, সরকার বাহাদুর যখন দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত আহার ও বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তখন তিনি তো আর সেই আইন ভাঙতে পারেন না, তাছাড়া  জেলার সাহেবেরও উচিত আইন না ভাঙা। এই কথা শুনে তো ব্যারী সাহেবের চক্ষু চড়কগাছ। সেলুলার জেলে এই প্রথম ব্যারী সাহেব অনুভব করলেন যে তাঁর কর্তৃত্বে ক্ষয় ধরেছে।  বেশ কিছুক্ষণ পরে খাওয়া শেষ করে নন্দগোপাল নিজের কুঠুরিতে গিয়ে ঢুকলেন। বিব্রত ওয়ার্ডাররা এবার তাঁকে কাজ শুরু করতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু নন্দগোপাল তাদের পাত্তা না দিয়ে একটা কম্বল নিয়ে আস্তে আস্তে বিছানা পেতে শুয়ে পড়লেন। অজস্র গালাগালিতেও তাঁর বিশ্রামের ব্যাঘাত হল না। উপেনের মতে, Passive resistance-এ তিনি মহাত্মা গান্ধীরও গুরু। বারোটার সময় উঠে নন্দগোপাল আরও একঘন্টা ঘানি ঘোরালেন। যখন দেখলেন যে, বালতিতে প্রায় পনেরো পাউন্ড তেল হয়েছে, তখন বাকি নারকেল বস্তাবন্দি করে চুপচাপ বসে রইলেন। কাজের তো অর্ধেক মাত্র হয়েছে, বাকি অর্ধেক এখন করবে কে? নন্দগোপাল বললেন, “যাহার খুশি সেই করিবে। আমি সত্যই কলুর বলদ নই যে, সমস্ত দিনই তেল পিষিব। দিনে ত’ ছয় পয়সারও খোরাক পাই না, তা ত্রিশ পাউণ্ড তেল পিষিব কেমন করিয়া?” নন্দগোপালের এই আপত্তিজনক আচরণে কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র বিরক্তই হল না, তারা একইসঙ্গে ভয় পেতেও শুরু করল।

স্বরাজ্য পত্রিকার ষষ্ঠ সম্পাদক, নন্দগোপাল চোপরা

 

কর্তৃপক্ষ মহলে একটা হুলুস্থুল পড়ে গেল। তর্জন গর্জন অনেক হল। কিন্তু নন্দগোপাল নির্বিকার পরমপুরুষের মতো নিষ্পন্দ এবং সদা স্মিতবদন। নন্দগোপালের কাছ থেকে তিরিশ পাউন্ড তেল বের করার কোনো আশা নেই দেখে সুপারিন্টেন্ডেন্ট মারে সাহেব তাঁকে পায়ে বেড়ি দিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কুঠুরিতে বন্ধ রাখার আদেশ দিলেন আর খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক করে দিলেন।

নন্দগোপালের আচরণ জেলের নিয়মানুবর্তিতাকে এই প্রথম চ্যালেঞ্জ জানাল। এইভাবে আরও এক মাস কেটে গেল। এরমধ্যে জেলার সাহেব নন্দগোপালের সাথে একটা রফা করে ফেললেন। বললেন যে, চারদিন পুরো কাজ করলে তিনি ভবিষ্যতে তাঁকে ঘানি ঘোরানো থেকে অব্যাহতি দেবেন। নন্দগোপালও রাজি হয়ে অন্যের সাহায্যে চারদিন পুরো কাজ দাখিল করে সে যাত্রায় নিষ্কৃতি পেল।

আরও পড়ুন
যমরাজার কারাগারে

এ নিষ্কৃতির আনন্দ কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হল না। অল্পদিন পরেই আবার তাঁকে ঘানিতে তেল পিষতে দেওয়াতে তিনি সে কাজ করতে অস্বীকার করলেন। তিনি সোজাসুজি বললেন যে তিনি কলুর বলদ নন, তিনি একজন মানুষ। এটা তো রীতিমতো বিদ্রোহ! ফল – বেড়ি ও কুঠুরি বন্ধ। হুকুম হল, সবাইকে আবার তিন দিনের জন্য জেলে ঘানি ঘোরাতে হবে। অনেকেই এবার ঘানিতে কাজ করতে অস্বীকার করলেন। ধর্মঘট আরম্ভ হল।

উপেনের লেখায় পাওয়া যায় – সাজার ওপর সাজা চলতে লাগিল। চারদিন কঞ্জিভক্ষণ ও সাতদিন দাঁড়া হাতকড়ি, এটাই সাধারণত সাজার প্রথম কিস্তি। খাবার হিসাবে সারাদিনে বরাদ্দ এক পাউন্ড করে দু’বার ‘কঞ্জি’। তার ওপর নানা রকমের বেড়ির পালা শেষ করে ধর্মঘটিদের কুঠুরিতে বন্ধ করা হল। সাধারণ কয়েদিদের কুঠুরি বন্ধ করা হলে তারা নিচে এসে স্নানাহার করতে পারে, অন্য কয়েদিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলারও বাধা নেই। এখন নতুন নির্দেশ জারি হল যে, তাঁদের সঙ্গে কেউ কথা বললে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। অনেককেই তিন মাস বা তার বেশি সময়ে পৃথক ও নিভৃত কুঠুরি-বন্ধ অবস্থায় কাটাতে হল। অনেকেরই এই সময় স্বাস্থ্যভঙ্গ হতে লাগল। একে পোর্ট ব্লেয়ারে ম্যালেরিয়ার প্রচণ্ড প্রকোপ। জ্বরজারি লেগেই আছে, তার ওপর আমাশা শুরু হল। 

আরও পড়ুন
ভি. ডি. সাভারকরের কথা

সেলের ভেতরে পায়ে বেড়িতে আবদ্ধ রাজবন্দি (স্থিরচিত্র)

 

চারদিন ধরে ধর্মঘটিদের খাবার জন্য দুবেলা শুধুমাত্র ‘কঞ্জি’র বরাদ্দ হলেও, উল্লাসকর, নন্দগোপাল এবং হোতিলালের এই শাস্তি চলল টানা দু’ সপ্তাহ। পৃথক ও নির্জন কারাবাস, শুধুমাত্র কঞ্জি ভক্ষণ এবং হাতকড়ি, দাঁড়াকড়ি, ডাণ্ডাবেড়ির টানা ভয়ানক শাস্তিতে এঁদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়লেও কেউই মাথা নত করলেন না। কিছুতেই এঁদের দমন করতে না পেরে অবশেষে জেল কর্তৃপক্ষকে নতি স্বীকার করতে হল। উপেনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে, রাজবন্দিদের মধ্যে কয়েকজনকে জেলের ভেতরে ভারী ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ থেকে মুক্তি দিয়ে করোনেশন উৎসবের সময় জেলের বাইরে সেটেলমেন্টে কাজ করতে পাঠানো হল। বারীন গেলেন ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইলে অর্থাৎ রাজমিস্ত্রির সাথে মজুরি করতে, উল্লাসকর গেলেন মাটি কেটে ইঁট বানাতে, কাউকে কাঠ কাটতে জঙ্গলে পাঠানো হল, কাউকে রিকশা টানার কাজ দেওয়া হল আবার কাউকে পাঠানো হল বাঁধ বাঁধার কাজে।

আরও পড়ুন
দিকে দিকে অবাধ্যতার ঢেউ

প্রথম প্রথম মনে হল বাইরে এসে বুঝি মুক্তির স্বাদ পাওয়া গেল। কিন্তু বাইরে কাজ করতে এসে হিতে বিপরীত হল। জেলখানার মধ্যে কাজ যতই কঠোর হোক না কেন, সরকার থেকে নির্দিষ্ট খোরাকি পাওয়া যেত আর জল-বৃষ্টিতে ভিজতে হত না। কিন্তু বাইরে সবকিছু বদলে গেল। কয়েদির খোরাকি এখানে চুরি হয়ে বাজারে ও গ্রামে গ্রামে বেচে দেওয়া হয়, ফলে কয়েদিরা পরিমাণ মতো খোরাকি থেকে বঞ্চিত হয়। এর ওপর সকাল ৬-টা থেকে ১০-টা ও দুপুর ১-টা থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে তো হতই, জল-বৃষ্টিতে কাজ থেকে রেহাই মিলত না। জঙ্গলে যাঁরা কাজে যেতেন তাঁরা আবার জোঁকের কবলে পড়ে জেরবার হয়ে জঙ্গল করতে যেতে চাইতেন না। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে্ কয়েদিরা অচিরেই জ্বরে পড়তেন। জেলের বাইরে হাসপাতাল থাকলেও ডাক্তার যেহেতু বাঙালি তাই সেখানে বাঙালি কয়েদিদের চিকিৎসা করা বারণ ছিল। তাই অসুস্থ হলে কয়েদিকে জেলে ফিরে যেতে হত। ‘জ্বরে ধুঁকিতে ধুঁকিতে বিছানা ও থালা-বাটি ঘাড়ে করিয়া পাঁচ-সাত দশ মাইল হাঁটিয়া আসা বড় সুবিধার কথা নয়।’ আর জেলে ফিরে এলেই বা সুচিকিৎসা কোথায়? হাসপাতাল সংলগ্ন কতগুলি ছোট ছোট কুঠুরিতে অসুস্থ কয়েদির থাকার ব্যবস্থা। আর সেই কুঠুরির মধ্যেই একটি গামলায় মল-মুত্র ত্যাগের ব্যবস্থা। মাথার ওপরে একটা ঘুলঘুলি দিয়ে বৃষ্টির সময় ছাঁট আসে কিন্তু কুঠুরিতে বিশুদ্ধ বায়ু চলাচলের কোনো উপায় নেই।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সেলুলার জেলের তিন যমদূত