যমরাজার কারাগারে

‘কালাপানি’ আন্দামান – ১৪

আগের পর্বে

কার্জনের বাংলাভাগের সময় পুনেতে ‘অভিনব ভারত’ গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলেন বিনায়ক সাভারকার। ১৯০৬ সালে লন্ডনের গ্রে’স ইন-এ ব্যারিস্টারি পড়তে যান তিনি। সেখানে মারাঠি ভাষায় গারিবলডির আত্মজীবনী এবং সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাসের ওপর একটি বই লেখেন তিনি। অন্যদিকে তাঁর দাদা বাবারাওকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে বিপ্লবী কবিতা লেখার জন্য। লন্ডন থেকে দামোদরের পাঠান পিস্তলেই খুন হন নাসিক জেলার ম্যাজিস্ট্রেট। মামলায় উঠে আসে তাঁর নাম। গ্রেপ্তারও হন সাভারকার। দু’দফায় ২৫ বছর করে ৫০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। দ্বীপান্তরিত করা হয় আন্দামানে। তারপর…

প্রতিদিন সকালে সেলুলার জেলে কয়েদিদের যে খাবার দেওয়া হত তা হল এক ডাব্বু (একটি অর্ধেক নারকেল মালা বা ওই সাইজের টিনের কৌটো) পরিমাণ কাঞ্জি বা গঞ্জি (ভাতের মাড়) – এতে না আছে লবণের লেশমাত্র, না আছে কোনো স্বাদ। জেলের কয়েদিদের জন্য রেশনে বরাদ্দ ৬ আউন্স চাল, রুটির জন্য ৫ আউন্স আটা, ২ আউন্স ডাল, ১ ড্রাম নুন, ৩/৪ ড্রাম তেল এবং ৮ আউন্স তরিতরকারি। (১ আউন্স = ২৯.৫৭৪ মিলিলিটার, ১ ড্রাম = ৩.৬৯৭ মিলিলিটার) এখানে রান্নায় যে তেল দেওয়া হত তা যে সব সময় নারকেল বা সর্ষের তেলই হত তা নয়, কখনো সখনো কেরোসিন তেলও রান্নায় ব্যবহৃত হত। এখানে পাকশালায় যারা রান্না করত তাদের শরীরে নানা ধরনের ব্যাধির বাসা। তাদের নোংরা জামাকাপড়, ঘেমো চেহারা, রান্না করার সময় খাবারের মধ্যে টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়া, তারপর সেই খাবার বন্দিদের জন্য নিয়ে আসা হত। কচুর গোড়া, ডাঁটা ও পাতা, চুবড়ি আল, খোসাসমেত কাঁচ কলা ও পুঁই শাক, ঘাস, পাতা, শিকড়বাকড়, গাছের ডালপালা, তার সঙ্গে সমুদ্রের বালি, ইঁদুরনাদি কোনো কিছুই বাদ যেত না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নামগন্ধ কিছু নেই। এখানে সমস্ত ধরনের চেহারা ও ওজন ব্যতিরেকে কয়েদিদের জন্য খাদ্যের পরিমাপ ওই একই। বারীনের মতো রোগাপাতলা স্বল্পাহারীর জন্য যেটুকু খাবার বরাদ্দ, সেটুকু পরিমাণই বরাদ্দ বিশাল চেহারার দৈত্য সদৃশ পাঞ্জাবি কয়েদিদের জন্যও। বারীন ঘোষের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, প্রথম দিন সেলুলার জেলে ঢোকার কিছুক্ষণ পরে প্রত্যেককে একটি করে মরচে ধরা, তেলমাখা লোহার থালা ও বাটি দেওয়া হল আর খেতে দিল টিনের কৌটোয় (ডাব্বু) করে এক কৌটো ভাত, অড়হরের ডাল আর দু’খানা রুটি।

সেলুলার জেলে রাজবন্দিদের জীবন ছিল কঠিন। প্রতিমুহূর্তে তাঁদের শিরদাঁড়া নমনীয় করার প্রচেষ্টা জারি ছিল। এঁদের বেশিরভাগই শিক্ষিত ভদ্রঘরের সন্তান। প্রাক্-সেলুলার দশায় এঁদের সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রমের কোনো যোগ ছিল না। কিন্তু এখানে সর্বাধিক পরিশ্রমের কাজে তাঁদের যুক্ত করা হত। কলুতে যুক্ত করে শুকনো নারকেল ও সর্ষে পেষাই করে তেল বের করার কাজে ঘানিতে বলদের বদলে যুক্ত করা হত তাঁদের, বেঁধে দেওয়া হত তেল নিষ্কাশনের লক্ষ্যমাত্রা, তা পূরণ না করতে পারলে তাদের কপালে জুটত অবর্ণনীয় অত্যাচার। তা ছাড়া ছিল নারকেল ছোবড়া পেটাই করে তার থেকে তার বের করে দড়ি পাকানোর কাজ, যা ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। এর পাশাপাশি ছিল – বেত ও বাঁশের কাজ, শস্যপেষণ ও নারকেল ভাঙা, নারকেলের শাঁস শুকানো, নারকেলের মালা থেকে হুঁকোর খোল তৈরি, সিসলের (আনারস জাতীয় একধরনের গাছ) পাতা শুকিয়ে পেটাই করে তার থেকে আঁশ বের করা, জাল, কার্পেট ও তোয়ালে বানানো, নারকেল ও সিসলের আঁশ দিয়ে মাদুর-পাপোশ প্রভৃতি তৈরি করা, সর্ষে বীজ ঝাড়াই-বাছাই করে পরিষ্কার করা, কম্বল ঘষে ঘষে চকচকে করা, বাগান পরিষ্কার করা, পাহাড় থেকে পাথর কাটা, রাস্তা তৈরি ও দুরমুশ করে তা সমান করা, ইঁট পাঁজায় কাজ করা, এবং জলা ভরাট করার কাজ। এছাড়াও বন্দিদের দিয়ে জেলের আবর্জনা পরিষ্কার ও  নর্দমা সাফাইয়ের কাজ করানো হত। আবার জেল হাসপাতালে চাকর, সাফাইকর্মী, ওয়ার্ড কুলি এবং জেল অফিসে কেরানির কাজে নিযুক্ত করা হত।

জেলের নিয়মানুযায়ী যদিও বিশ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের দৈহিক পরিশ্রমের কাজে নিযুক্ত করা যায় না, শিক্ষিত কয়েদিদের কাজের জায়গা হয় জেলের প্রেসে ও অফিসে এবং কয়েদিদের কোন কাজে নিযুক্ত করা হবে তা পুরোপুরি নির্ভর করে তাদের দৈহিক সক্ষমতার ওপর। কিন্তু এখানে রাজবন্দিদের ক্ষেত্রে এই সমস্ত নিয়মের কোনো কিছুই মানা হয়নি। তাঁদের বেছে বেছে সবথেকে যে কঠিন কাজ, তা দেওয়া হত, তার সঙ্গে ছিল অকথ্য গালিগালাজ ও অত্যাচার, রেহাই মিলত না কিশোর রাজবন্দিদেরও। এসবই চলত পরিকল্পনা মাফিক যাতে তাঁদের মনোবল ভেঙে দেওয়া যায়। নানা ধরনের কাজের মধ্যে সবথেকে কঠিন পরিশ্রমের কাজ ছিল তেল পেষাই, নারকেলের ছোবড়া পেটাই ও দড়ি বানানো। উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নির্বাসিতের আত্মকথা থেকে আমরা জানতে পারি –  সকাল বেলা উঠে শৌচকর্মের কিছু পরেই অন্ন বা ‘কঞ্জি’ গলাধঃকরণ করে ‘ল্যাঙ্গোট’ এঁটে ছোবড়া পেটাতে বসতে হয়। কাঁধের ওপর পঞ্চাশ পাউন্ড নারকেলের বস্তা ও হাতে একটা বালতি নিয়ে তেতলায় চড়ে নিজের সেলে গিয়ে কাজ আরম্ভ  করতে হয়। প্রত্যেককে কুড়িটি নারকেলের শুকনো ছোবড়া দেওয়া হয়। একখণ্ড কাঠের উপর একটা ছোবড়া রেখে কাঠের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ছোবড়া নরম হলে তাদের উপরকার খোসা উঠিয়ে ফেলতে হয়। তারপর সেগুলি জলে ভিজিয়ে আবার পেটাতে হয়। পেটাতে পেটাতে ভেতরকার ভুসি ঝরে গিয়ে কেবলমাত্র তারগুলিই অবশিষ্ট থাকে। এই তারগুলি রোদে শুকিয়ে পরিষ্কার করে প্রত্যেক দিন এক সের করে একটা গোছা বানাতে হয়।  উপেন লিখছেন, “আট-দশ মিনিটের মধ্যেই দম চড়িয়া জিভ শুকাইতে আরম্ভ করে। এক ঘণ্টার মধ্যেই গা হাত পা যেন আড়ষ্ট হইয়া উঠিল। …দশটা ঘণ্টার পর যখন আহার করিতে নীচে নামিলাম, তখন হাতে ফোস্কা পড়িয়াছে, চোখে সরিষার ফুল ফু্টিতেছে আর কানে ঝিঁঝিঁপোকা ডাকিতেছে।”

নারকেলের ছোবড়া পেটানোর মতো আর একটি ভয়ানক পরিশ্রমের কাজ ছিল তেলের ঘানি বা কলু-তে কাজ করা। উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’এর নির্বাসিতের আত্মকথা, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ’এর দ্বীপান্তরের কথা এবং বিনায়ক দামোদর সাভারকরের The Story of My Transportation for Life  থেকে আমরা এই তেল পেষাইয়ের মারাত্মক পরিশ্রম এবং তার ফল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হই। এখানে তেল পেষাইয়ের যে ঘানি তা অনেকটা আমাদের কলুর বাড়ির দেশি ঘানির মতো, আবার আরেক ধরনের ঘানি আছে যা হাত দিয়ে ঘোরাতে হয়। এখানে কলুতে বলদের পরিবর্তে রাজবন্দিদের জুতে দেওয়া হত। প্রত্যেকদিন এক একজনকে দশ পাউন্ড সর্ষের তেল বা তিরিশ পাউন্ড নারকেল তেল পিষতে হয়। মোটা মোটা পালোয়ান লোকও ঘানি ঘোরাতে হিমসিম খেয়ে যায়। জেলের যে অংশে তেল পেষা হয় দু’জন পাঠান পেটি অফিসার তখন সেখানকার হর্তাকর্তা। সেখানে ঢোকামাত্র তাদের মধ্যে একজন তার হাত মুঠো করে সবার নাকের ওপর রেখে বেশ জোর গলায় বুঝিয়ে দিল যে, কাজকর্ম ঠিক ঠিক না করতে পারলে সে সবার নাকগুলি ঘুষি মেরে থ্যাবড়া করে দেবে। কাজে এতটুকু ঢিলা দেবার উপায় নেই। শরীর না চললেও ঘানি ঘুরিয়ে যেতে হবে নয়তো ভদ্রলোক কয়েদিদের জন্য প্রযুক্ত হবে হিন্দির সাথে পাঞ্জাবি, পাঠান ও বেলুচি মিশিয়ে সে এমন এক খিচুড়ি গালাগালি যা আয়ত্ত করতে অন্ততপক্ষে সাতটি জন্ম নেওয়া অবধারিত।

আরও পড়ুন
ভি. ডি. সাভারকরের কথা

এই ঘানি ঘোরানোর কাজে লাগে প্রচণ্ড শক্তি। এখানে যে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিরা এসেছেন তাঁদের বয়স এবং শারীরিক ক্ষমতাকে মান্যতা না দিয়ে জুতে দেওয়া হত এই ঘানিতে। এখানে একজন শক্তিশালী মানুষের পক্ষে সারাদিনে ৩০ পাউন্ড তেল বের করা এক দুঃসাধ্য কাজ। এখানে আসার আগে যাঁরা কোনদিন কোনো শারীরিক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তাঁদের বাধ্য করা হল এই কাজে। কোটা পূরণ করতেই হবে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে, কোনোমতে শৌচকর্ম সেরে, কঞ্জি গিলে শুরু করে দিতে হত কাজ। সকাল দশটার ঘন্টা পড়লে খাবার সময়। কোনমতে নাকে মুখে কিছু গুঁজে দিনের কোটা শেষ করতে কাজ চালিয়ে যেতেন বন্দিরা। বিকেল পাঁচটায় সারাদিনের পরিশ্রমে শরীর যখন আর চলছে না, তখনও রেহাই মিলত না। কাজ চলত রাত আটটা-ন’টা পর্যন্ত। এবার স্বয়ং ব্যারী সাহেব এসে বসতেন চেয়ারে। প্রযুক্ত হত বাছবাছা গালাগাল, শাস্তির ভয় দেখানো। ব্যারী সাহেব চেয়ারে বসে ঘুমে ঢুলতেন, নাক ডাকতেন আর মাঝেমাঝে হুঁশে এলে তর্জন-গর্জন করতেন।  অনেকেই আন্দামানের অসহনীয় গরমে কাজ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, হাত টনটন করত, মাথা-বুক-পেট ব্যথা করত, বমি হত। কিন্তু তাঁদের জন্য চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাই রাখা হত না। এখানে জেলের হাসপাতালে সাধারণ কয়েদি থেকে মারাত্মক খুনির জন্য বেড বরাদ্দ আছে কিন্তু এই রাজবন্দিদের জন্য সব ধরনের চিকিৎসা অস্বীকৃত।

আরও পড়ুন
দিকে দিকে অবাধ্যতার ঢেউ

কাজের কোটা শেষ করতে সাধারণত দু’দিন লাগত। তাতেও যদি তা না হত তাহলে তাঁর জন্য শাস্তি বরাদ্দ ছিল একসপ্তাহের হাতকড়ি। দ্বিতীয় বার এরকম ঘটলে একসপ্তাহ হাতকড়ির সঙ্গে যুক্ত হত অর্ধেক পরিমাণ খাবার। এরপরেও যদি তাঁর কাছ থেকে বরাদ্দমতো কাজ না পাওয়া যেত তাহলে একমাসের জন্য হাতকড়ি ও কম পরিমাণ খাবারের সঙ্গে যুক্ত হত দশ দিনের ক্রশ-বার – যেক্ষেত্রে অপরাধীকে দুই পা ফাঁক করিয়ে বেড়ি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হত দীর্ঘসময়ের জন্য। তাতেও যদি কাজ না হত তাহলে এই শাস্তি ছয়মাস পর্যন্ত প্রলম্বিত হত, আর তার সঙ্গে যুক্ত হত সলিটারি কনফাইনমেন্ট বা নিভৃত কারাবাস।

জেলের ভেতরে রাজবন্দিদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাতেও নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। একদিনের দুর্দশার কথা লিখছেন উপেন। রবিবারেও কাজ থেকে নিষ্কৃতি নেই। নিচ থেকে বালতি বালতি জল তুলে দোতলা ও তেতলার বারান্দা নারকেল ছোবড়া দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করতে হত। একদিন ওরকম কাজ করবার সময় তিনি দেখলেন যে অদূরে উল্লাসকর কাজ করছেন। উপেনের খুব সাধ হল একটিবার তার সঙ্গে কথা বলেন। দুই-এক পা করে এগিয়ে গিয়ে উল্লাসের কাছাকাছি গিয়ে তাঁকে ডাকামাত্র পিঠের ওপর একটা বিষম কিল পড়ল। পিছনে মুখ ফেরানো মাত্র গালে আর এক ঘুষি। যমদূতসম পাঠান প্রহরী মহম্মদ শা এইভাবে হুকুম তামিল ও জেলের শান্তিরক্ষা করত।

আরও পড়ুন
সেলুলার জেলের তিন যমদূত

এই যমরাজার কারাগারে যারা প্রহরী, তারা –  “রামলাল ফাইলে টেড়া হইতে বসিয়াছে, দাও উহার ঘাড়ে দুইটা রদ্দা; মুস্তাফা আওয়াজ দিবামাত্র খাড়া হয় নাই, অতএব উহার গোঁফ ছিড়িয়া লও; বকাউল্লার পায়খানা হইতে ফিরিতে বিলম্ব হইয়াছে, অতএব তিন ডাণ্ডা লাগাইয়া উহার পশ্চাদ্দেশ ঢিলা করিয়া দাও” - এইভাবে নানারকম ক্ষমতা প্রয়োগে জেলখানার শৃঙ্খলা রক্ষা করত।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
আন্দামান সফরে