ক্যানসারের চিকিৎসায় উৎসর্গ করেছিলেন জীবন, প্রয়াত ডঃ বিশ্বনাথন শান্তা

ক্যানসার এমনই এক রোগ, যা ভেতর থেকে শেষ করে দেয় মানুষকে। খানিকটা সময় এই মারণ রোগকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলেও, পরিত্রাণ নেই কোনো। কিন্তু সেই চিকিৎসাও যে ব্যয়বহুল। সাধারণ দরিদ্র মানুষের আয়ত্তের বাইরে তার খরচ। সমাধান খুঁজতে চেন্নাইয়ের ক্যানসার ইনস্টিটিউটে শুরু করেছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা। নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন স্বল্প খরচে সাধারণের ক্যানসার চিকিৎসার জন্য। সেইসঙ্গে কর্কট রোগ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা তো রয়েছেই। চলে গেলেন বিশিষ্ট ক্যানসার বিশেষজ্ঞ এবং অ্যাডয়ার ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের চেয়ারপার্সন ডাঃ বিশ্বনাথন শান্তা।

সোমবার রাত থেকেই বেড়েছিল শারীরিক সমস্যা। মঙ্গলবার ভোর রাতে তাঁকে ভর্তি করা হয় চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে। প্রাথমিক পরীক্ষার পরেই দেখা যায়, রক্তনালিতে একটি ব্লকেজের কারণে আশঙ্কাজনক প্রভাব পড়েছে রক্তপ্রবাহে। অস্ত্রোপচার করা হলেও, ব্যর্থ হয় চিকিৎসকদের প্রচেষ্টা। ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটে হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি চিকিৎসক। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।

১৯২৭ সালের ১১ মার্চ চেন্নাইয়ের মাইলাপুরে জন্ম ডাঃ ভি শান্তার। ছোটো থেকেই বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশে বেড়ে ওঠা। পরিবারের দুই সদস্য ততদিনে সম্মানিত হয়েছেন নোবেল পুরস্কারে। পদার্থবিদ সি.ভি. রমন ছিলেন তাঁর খুড়তুতো দাদু। এস চন্দ্রশেখর তাঁর কাকা।

ন্যাশনাল গার্লস হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন চেপে বসেছিল তাঁর মনে। ১৯৪৮ সালে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস সম্পূর্ণ করেন তিনি। তবে সরে আসেননি পড়াশোনা থেকে। ১৯৫২ সালে ডি.জি.ও. এবং ১৯৫৫ সালে প্রস্থেটিক্স এবং স্ত্রীরোগ-চিকিৎসায় এমডি করেন ডাঃ ভি শান্তা। এমডি চলাকালীনই ১৯৫৪ সালে চেন্নাইয়ে ডাঃ মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি প্রতিষ্ঠা করেন ক্যানসার ইনস্টিটিউট। অথচ সে সময়ে ক্যানসারের জন্য বিশিষ্ট চিকিৎসক কই? এমডি শেষ করেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসার কাজেই হাত লাগাবেন তিনি।

ততদিনে অবশ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছেন। সরকারি হাসপাতালে মহিলা এবং শিশু বিভাগে যোগদান করার জন্য, বাড়িতে চলে এসেছে চিঠিও। তবে সে পথে না গিয়েই নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন ডাঃ ভি শান্তা। পরিবারের অমতে গিয়েই।

যখন কাজ শুরু করেন, এই ক্যানসার ইনস্টিটিউটে তখন এক ফালি হাসপাতালে মাত্র ১২টি শয্যা। চিকিৎসার সরঞ্জামও ন্যূনতম। প্রতিষ্ঠাতা মুথুলক্ষ্মী রেড্ডির পুত্র ডাঃ কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে জুটি বেঁধে সেই অসম লড়াইতেই নামলেন তিনি। একজন সাম্মানিক চিকিৎসক হিসাবে। শুরুতে বিনামূল্যেই চিকিৎসা করতেন ডঃ শান্তা। পরবর্তীকালে তাঁর জন্য প্রতিবাসে ২০০ টাকা বেতনের ব্যবস্থা করে দেয় ইনস্টিটিউট। ক্যাম্পাসে থাকার জন্য করে দেওয়া হয় আলাদা জায়গাও। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেখানেই থেকেছেন তিনি। নিজের ব্যক্তিগত সঞ্চয় ভাঙিয়েই বাড়িয়েছেন হাসপাতালের পরিকাঠামো। সেদিনের ১২ শয্যার সেই ক্যানসার ইনস্টিটিউট আজ ৪০০ বেডের একটি সম্পূর্ণ হাসপাতাল। যার মধ্যে ৩০০টি শয্যাই বিনামূল্যে চিকিৎসার। 

আরও পড়ুন
ক্যানসারেই মৃত্যু নেপোলিয়নের, সুদূর সেন্ট হেলেনা থেকে মাদ্রাজে এসে পৌঁছল চিঠি

তবে শুধু চিকিৎসার কথা বলা হলে অনেকটাই সরলীকৃত করা হয়ে যায় তাঁর কর্মযজ্ঞকে। একদিকে যেমন দরিদ্রদের স্বল্প খরচে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য উজাড় করে দিয়েছিলেন নিজের সবটুকু, তেমনই ক্যানসার প্রতিকার এবং এই রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন বিশ্বনাথন শান্তা। এমনকি সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রচার সভাতেও অংশ নিতেন তিনি। পরিসংখ্যান জানান দেয়, কর্মরত অবস্থায় প্রতিবছর ১ লক্ষ ক্যানসার রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশকেই বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা প্রদান করেছিলেন।

পাশাপাশি ক্যানসারের প্রকৃতি, ওষুধ এবং প্রতিকারের ওপরে বিস্তারিত গবেষণাও করেছেন ডঃ শান্তা। তাঁর হাত ধরেই জন্ম নিয়েছে ক্যানসার চিকিৎসার বিভিন্ন বিশেষ বিভাগ। তাঁর প্রশিক্ষণে উঠে এসেছে ভারতের প্রথম সারির কয়েকশো অঙ্কোলজিস্টও। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত অ্যাডয়ার ক্যানসার ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। তাছাড়াও ছিলেন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক একাধিক কমিটির সদস্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা মণ্ডলীতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর।

কর্কট রোগের ওপর গবেষণা এবং প্রতিকারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেওয়ার জন্য পেয়েছেন একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানও। ২০০৫ সালে রমন ম্যাগসেসে পুরস্কারে ভূষিত হন শান্তা। তাছাড়াও ঝুলিতে রয়েছে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ এবং পদ্মবিভূষণ। 

আরও পড়ুন
পৃথিবীর বিরলতম ক্যানসারের চিকিৎসায় পথ দেখাচ্ছে আণুবীক্ষণিক কৃমি

শেষ বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে চিকিৎসায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করতে পারলেও ছেড়ে যেতে চাননি স্বপ্নের ক্যানসার ইনস্টিটিউট। পরিবারের তবে দিনের ২৪ ঘণ্টার যেকোনো সময়ই তাঁর কাছে ছুটে গেলে পাওয়া যেত উপদেশ। কোন রোগীকে, ঠিক কেমন চিকিৎসা করলে দ্রুত ফল পাওয়া যাবে— তাও কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জানিয়ে দিতেন অশীতিপর চিকিৎসক। ফাঁকা হয়ে গেল সেই অভিভাবকত্বের জায়গাটাই...

Powered by Froala Editor

Latest News See More