আজও মুসলমান ভক্ত-কবির সমাধির পাশে থমকে দাঁড়ায় পুরীর রথ

শ্রীক্ষেত্র এমন এক উদারতার তীর্থ, যেখানে সকল ভক্তের নয়নপথগামী হয়ে মন্দির ছেড়ে পথে বেরিয়ে আসেন দেবতা। যেখানে সেই দেবতার মহাপ্রসাদ কখনও উচ্ছিষ্ট হয় না, এমনকি স্পর্শদোষও লাগে না। চণ্ডালের হাত থেকে অনায়াসে প্রসাদান্ন গ্রহণ করেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। শ্রীচৈতন্যের অন্ত্যলীলাস্থলী জগন্নাথপুরী, যেখানে বংশপরম্পরায় জগন্নাথের রথের গমনপথ স্বহস্তে ঝাঁট দেন স্বয়ং রাজা। এ হেন শ্রীক্ষেত্রেরই এক যবন-কুলজাত কবি একদা লিখেছিলেন—

"অহে নীল শৈল প্রবল মত্ত বারণ। মো আরত নলিনীবনকু করু দলন।" -আমার আর্ত জীবন জুড়ে অজস্র বেদনা পদ্মের মতো ফুটে রয়েছে, হে নীল পর্বতের মতো বিশাল, প্রচণ্ড মত্ত গজরাজ, তুমি তোমার পদপাতে সেই কমলবন দলিত, ভ্রষ্ট, বিধ্বস্ত করে দাও। 

নীলাচল-অধিপতি শ্রীজগন্নাথের উদ্দেশে এই গান রচনা করেছিলেন কবি সালবেগ (Poet Salabega)। সপ্তদশ শতকের উৎকল-দেশের কবিসমাজের অন্যতম রত্ন তিনি।

সালবেগের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত। উড়িষ্যার জনৈক মুসলমান সুবেদার লালবেগ এক স্নানসিক্তা হিন্দু বিধবার রূপে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বলপূর্বক হরণ ও বিবাহ করেন। সেই নারীর গর্ভেই সালবেগের জন্ম হয় (সম্ভবত ১৬০৭ কিংবা ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দ)। কালক্রমে, পিতার মৃত্যুর পর যুবক সালবেগ কোনো-এক যুদ্ধে গুরুতর আহত হলেন। পুত্রের প্রাণসংশয় দেখে তাঁর মা নিজের পূর্ব-সংস্কার স্মরণ করে সালবেগকে বললেন, শ্রীক্ষেত্রপতি জগন্নাথের শরণ নাও। জগন্নাথের কাছে জীবনভিক্ষা করে সালবেগ সুস্থ হয়ে উঠলেন।

আরও পড়ুন
মাহেশে রথের মেলায় জুয়ার আসর, মাত্র দশ টাকায় বিক্রি করে দিলেন স্ত্রী-কে!

প্রাণদাতা ঈশ্বরের দর্শন লাভ করার জন্য নীলাচলে এলেন সালবেগ, কিন্তু জাতি-পরিচয়ের বাধা কাটিয়ে তিনি শ্রীমন্দিরে প্রবেশের অনুমতি পেলেন না। বিষণ্ণ সালবেগ বৃন্দাবনে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান-ধারণায় মগ্ন হলেন। কিছুদিন পরে তিনি রথযাত্রা দর্শনের উদ্দেশ্যে পুরীতে ফিরে আসার জন্য রওনা দিলেন। রথযাত্রা এমন এক উৎসব, যখন বিশ্বের দেবতা দেবালয়ের ঐশ্বর্য ত্যাগ করে নেমে আসেন পথে, সর্বস্তরের ভক্ত তাঁর দর্শন লাভ করে ধন্যাতিধন্য হয়। এই অপূর্ব সুযোগের সদ্ব্যবহারে উৎকণ্ঠিত সালবেগ রওয়ানা দিলেন নীলাচলের উদ্দেশ্যে।

আরও পড়ুন
‘পুরীর জগন্নাথ মন্দির আসলে একটি বৌদ্ধ মন্দির’ - বলেছিলেন বিবেকানন্দ, বুদ্ধের দন্তযাত্রার অনুকরণেই শুরু রথযাত্রা!

পথে আকস্মিক অসুস্থতায় বিপর্যস্ত হলেন সালবেগ। কিন্তু, কী আশ্চর্য, একটি বিশেষ স্থানে এসে জগন্নাথের রথ নন্দীঘোষের গতি অকস্মাৎ রুদ্ধ হল। যতক্ষণ না সালবেগ সেখানে এসে রথারূঢ় জীবনেশ্বরকে প্রাণ ভরে দর্শন করলেন, ততক্ষণ সেই রথ একচুলও নড়ল না।

আরও পড়ুন
চৈতন্যদেব নাম দিয়েছিলেন ‘নব-নীলাচল’, বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে শ্রীরামপুর

ভবিষ্যতে জগন্নাথের উদ্দেশে প্রাণের আর্তি জানিয়ে ওড়িয়া ভাষায় বহু সঙ্গীত রচনা করেছিলেন সালবেগ। রাধাকৃষ্ণের মধুরোজ্জ্বল লীলাবিলাস বিষয়েও লিখেছিলেন অজস্র গান। মধ্যযুগের ওড়িয়া ভক্তিসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে তাঁর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।

ঠিক যেখানে জগন্নাথের রথ তাঁর ভক্তের অপেক্ষায় স্তব্ধ হয়েছিল, সেখানে আজ সালবেগের সমাধি। প্রতি বছর রথযাত্রার সময় আজও নন্দীঘোষ কিছুক্ষণের জন্য এসে থামে সেই সমাধির পাশে। ভক্তদের মুখে শোনা যায় সালবেগের কালজয়ী পদ- "জগবন্ধু হে গোসাঁই/ তুম্ভ শ্রীচরণ বিনু অন্য গতি নাহিঁ..."।

হে জগবন্ধু, হে বিশ্বপতি,
তোমার শ্রীচরণ ছাড়া অন্য কোনও গতি নেই আমার।
সাতশো পঞ্চাশ ক্রোশ পথ পাড়ি দেওয়া বড়ো দুরূহ, হে প্রভু! কৃপা করে ততক্ষণ নন্দীঘোষেই থাকো।
চক্রবৎ বৃহৎ নয়ন তোমার, হে নাথ! চারপাশে মুক্তার ঝালর দিয়ে সাজানো রথে চড়েছ তুমি, কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়!
বাইশ ধাপ সোপানের ঊর্ধ্বে তোমার নিত্য অধিষ্ঠান। তার নীচে তোমার মহাপ্রসাদান্ন লাভ করে আমি কৈবল্যমুক্তি লাভ করব। প্রভু, ততক্ষণ অপেক্ষা করো।
আগে চলেছেন বলভদ্র, মধ্যে চলেছেন চন্দ্রমুখী সুভদ্রা, আর ওই যে, মহা কোলাহল করে পিছে পিছে আসছেন কালিয়া- কৃষ্ণবর্ণ শ্রীজগন্নাথ!
সালবেগ বলছেন, প্রভু, আমি হীনজাতি যবন, কৃপা করে আজ্ঞা দাও, যেন শ্রীবৃন্দাবনে ঠাঁই পাই।
(ভাবানুবাদ- লেখক)

Powered by Froala Editor