গোলাপি সাইকেল ও রঙিন ছেলেবেলার নব্বই

'ছেঁড়া ঘুড়ি, রঙিন বল'

প্রথম পর্ব

ভূমিষ্ঠ হওয়া ১৯৯৪ সালে। নব্বইয়ের শিশু কিশোরদের এক অনিবার্য মায়া সে। আজ বয়স পঁচিশ, অথচ কী সাবলীল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাস্তাঘাট। কেউ কেউ ঘরকুনো হয়ে পড়েছে বয়সে। কারুর সঙ্গী দূরে চলে গেছে বলে বাড়ি থেকে বেরোনো হয় না আর। গায়ের রঙ গোলাপি থেকে ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কখনও টিউশন থেকে বাড়ি ফেরা, বাড়ি থেকে বাজার। কখনও বাবার সঙ্গেও বেরিয়ে পড়া প্রয়োজনে। হাতের কালো ঝুড়িতে চিঠি ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত ছুটে চলে যায় ভালোলাগারা। এমনই ছিল আমাদের ছেলেবেলার প্রেম। আর এত ভূমিকা যাকে নিয়ে, সে লেডিবার্ড। হ্যাঁ আমাদের নব্বইয়ের নব্বই শতাংশ যুবকের বুকে ব্যথার সঙ্গে জড়িয়ে যে মায়াবী সাইকেল! বি এস এ-এর অন্যতম সফল কাজ। ৯০ পরবর্তীর তরুণ সমাজ জানে কীভাবে প্রতিটা অনুভূতিতে জড়িয়ে রয়েছে এই সাইকেল। ধীরে ধীরে একটি মডেল থেকে আস্ত একটা রেঞ্জ হয়ে উঠতে দেখলাম আমরা। এই রেঞ্জে এখন মোট নটি মডেল। তার সবকটিই সাত হাজারের কাছাকাছি দাম।

ক্লাস সেভেনের রেজাল্ট ভালো করে যে মেয়েরা তাদের লেডিবার্ড উপহার পেয়েছিল বাবার কাছ থেকে, এখনও খোঁজ নিলে জানা যাবে তারা অনেকেই বিক্রি করতে দেয়নি সেই সাইকেল। কারুর সিঁড়ির তলায় রয়ে গেছে স্মৃতি হয়ে, কেউ বোনের হাতে তুলে দিয়েছে নির্দ্বিধায়। রাস্তার ধারে লুকিয়ে দেখেছি কীভাবে গাছের ফুল থেকে অসুস্থ বিড়াল পর্যন্ত জায়গা পেয়েছে বাস্কেটে। দোলের পর একমাসেও গায়ের রং ওঠেনি তাদের। দু’পায়ের অদ্ভুত ব্যালেন্সে শহর নয়, যেন ক্রমশ বুকের ভিতর ঢুকে এসেছে তারা। গুবরে পোকা। আমাদের এক একটি পাহাড়প্রমাণ প্রথম প্রেম, অভিমানে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে শব্দ করে। সকালে উঁকি দিয়ে দেখতে চেয়েছি কালো হাতলের গোলাপি সাইকেলটি তার যথাস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কি না!

https://www.youtube.com/watch?v=W1pZBkb_mkM

সে এক দিন ছিল, বায়োলজি কোচিং থেকে বেরিয়ে সাইকেলের পিছনে ধাওয়া। ঝুড়িতে চিঠি ফেলে দিয়ে আমরাও পালিয়েছি বহুবার। অথবা চুপিচুপি পিছু নিয়ে বাড়ি চিনে এসেছি। এমন এক ক্লাসিক সাইকেল নিয়ে তারা বাঁক পেরিয়ে মিশে গেছে শেষের গলিতে। সেখান অব্দি পৌঁছানোয় নিষেধ আমাদের। চাকা ঘুরিয়ে নিয়েছি ফের। মেয়েটির জন্মদিন ১৩ই জুন হতে পারে। অথবা ১৯শে এপ্রিল। একটা নিচু স্বরের বেল বাজিয়ে পাশে ডেকে নিয়েছে দাঁড়ানো হারকিউলিসকে। বিবি’স্ট্রিট থেকে পাশাপাশি গিয়েছি মালিকপাড়া। সাইকেল-বেলের এক ভাষা রপ্ত ছিল আমাদের। সেসব এখন লোপ পেতে বসেছে সময়ের সঙ্গে। লেডিবার্ডের মালিকেরা অনেকেই এই মুহূর্তে প্রবাসে। তবু গোটা শহর বাড়িতে বাড়িতে অন্ধকারে পড়ে রয়েছে কত হৃদয় ভাঙা গল্প, কত না রাখতে পারা কথা। যে যার প্রায়োরিটি নিয়ে চলে এগিয়ে ফেলেছি লাইফ সাইকেল। পথ ছেড়ে গেছে, স্মৃতি রয়ে গেছে কোণঠাসা হয়ে।

পৌলমীদি সিক্সে ফার্স্ট হয়ে পেয়েছিল সবুজ রঙের লেডিবার্ড। এখনও ওটাতেই চড়ে বাজারে আসে। আর ক্যারিয়ারে একটা ছোট্ট চেয়ার বাঁধা, তাতে বসিয়ে ছেলেকে পৌঁছে দিয়ে যায় আমাদের স্কুলে।

পঁচিশে পা দিল লেডিবার্ড। একটা গোটা প্রজন্মকে লালন করল এই সাইকেল। না কেবল সাইকেল না। তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু ভাবলেও কমই ভেবে বসব আমরা...