এ যেন দুটো আলাদা পৃথিবীর গল্প। একটা পৃথিবীতে চলছে অত্যাধুনিক বিদ্যুতচালিত গাড়ি। মোবাইলে বাজছে গান, ল্যাপটপের এক ক্লিকে দুনিয়া চলে আসছে হাতের মুঠোয়। আরেকটা পৃথিবীতে শুকিয়ে আসছে অরণ্য। রুক্ষ হচ্ছে উর্বর মাটি, দূষিত জলে মেটাতে হচ্ছে তৃষ্ণা। মৃত্যুদূতের মতো আঘাত করতে চলেছে দুর্ভিক্ষ।
যোগসূত্র কোথায় দুটি পৃথিবীর মধ্যে? উত্তর— সাদা সোনা (White Gold)। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে ‘লিথিয়াম’ (Lithium)। মোবাইল বা ল্যাপটপের ‘রিচার্জেবল ব্যাটারি’ তৈরিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি মৌল। ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারির সৌজন্যে দ্রুত হারে বাড়ছে লিথিয়ামের চাহিদা। আর সেই কারণেই বিপদে পড়েছেন আর্জেন্টিনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কয়েক হাজার আদিবাসী মানুষ। লিথিয়ামের খনির দাপটে বিষাক্ত জল আর অনুর্বর মাটিতে বিপন্ন হয়ে উঠছে তাঁদের অস্তিত্ব। একই সঙ্গে প্রশাসনিক অত্যাচারে হারাতে হচ্ছে বসতভিটে।
ঘটনার কেন্দ্রস্থল— হুহুই (Jujuy) প্রদেশ। আর্জেন্টিনার উত্তরাঞ্চলে আন্দেস পর্বতের কোল ঘেঁষা প্রাচীন পার্বত্যভূমি। সবমিলিয়ে প্রায় ৪০০ আদিবাসী গোষ্ঠীর বাসস্থান। খাদ্য, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা সমস্তই প্রকৃতিনির্ভর। প্রায় কয়েকশো বছর ধরে তাঁরা আছেন এখানে। আর্জেন্টিনায় স্প্যানিশ উপনিবেশেরও আগে থেকে। বিশ্বমাতা বা ‘পাচামামা’-র আরাধনায় কাটে শান্ত-নিরুদ্বেগ জীবন।
অবশ্য আরেকটি পরিচয় আছে হুহুই-এর। সমস্যা দেখা দিয়েছে সেটি নিয়েই। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া আর চিলির সীমান্ত বরাবর অংশটি আসলে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লিথিয়ামের ভাণ্ডার। যাকে বলা হয় ‘লিথিয়াম ত্রিভুজ’। শুধুমাত্র উত্তর আর্জেন্টিনাতেই রয়েছে ৩৮টি খনি। সারা বিশ্বের নিষ্কাশিত লিথিয়ামের নিরিখে অবস্থান করে চতুর্থ স্থানে। মাটির তলা থেকে খনন করা লিথিয়ামের জন্য নির্মাণ করা হয় বৃহদাকারের কৃত্রিম পুকুর। সেখান থেকে নিষ্কাশিত হয় প্রয়োজনীয় উপাদানটি। আর পুরো প্রক্রিয়াটির জন্য দরকার প্রচুর জল। প্রতি টন লিথিয়ামের জন্য প্রয়োজন পড়ে কুড়ি লক্ষ লিটার জল। আপাতত হুহুই-এর আদিবাসীদের জন্য এই বিষাক্ত জলই বরাদ্দ।
আরও পড়ুন
নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য, জলবায়ু-সংক্রান্ত ঝুঁকিতে ভারতের ৯টি রাজ্য
তবে এখানেই বিপদের শেষ নয়। ২০২৩-এর জুনে হুহুই-এর সাংবিধানিক আইনে কিছু রদবদল করা হয়। যেখানে বলা হয়, প্রত্যেকটি জনজাতি গোষ্ঠীকে কাগজে-কলমে তাঁদের অধিকারে থাকা জমির প্রমাণ দিতে হবে। নতুবা হতে হবে উদ্বাস্তু। ঘটনাচক্রে হুহুই-এর অধিকাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ই শতাব্দী ধরে রয়েছে শুধুমাত্র মৌখিক চুক্তির উপর ভিত্তি করে। আইনত কোনো প্রমাণপত্র তাঁদের কাছে নেই। স্পষ্টতই লিথিয়াম দখলের রাজনীতির শিকার হতে হচ্ছে আদিবাসীদের। একই সঙ্গে খর্ব করা হয়েছে প্রতিবাদের অধিকারও।
আরও পড়ুন
কয়লা খননের জন্য উচ্ছেদ আস্ত শহর, প্রতিবাদ জার্মান পরিবেশকর্মীদের
বাধ্য হয়েই পথে নামে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির মিলিত সংগঠন। স্পষ্ট বক্তব্য, লিথিয়ামের অধিকার তাঁদের। আর টলানো যাবে না আদিবাসী উন্নয়নের নাটক আর দূষণ প্রতিরোধের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে। লিথিয়াম খনির প্রতিটি রাস্তা বন্ধ করে দেয় তাঁরা। শেষে নামাতে হয় পুলিশ। লাঠিচার্জে বন্ধ করা হয় বিক্ষোভ। অবশ্য প্রতিবাদ থামেনি। হুহুই-এর গণ্ডি ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে রাজধানী বুয়নেস আইরেসের উদ্দেশ্যে। ‘মালন দে লা পাজ’ বা ‘রেইড ফর পিস’-এর ব্যানার নিয়ে অবরোধ করে রাজধানীর রাস্তা। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় আর্জেন্টিনা প্রশাসনের। এর আগে ১৯৪৬ ও ২০০৬-তেও রাজধানী অবরোধের ইতিহাস আছে তাঁদের। লিথিয়াম খনির দূষণ ঠেকাতে সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে তাঁরা বধ্যপরিকর।
‘পাচামামা’ শক্তি জোগাচ্ছে তাঁদের। লড়াইটা শুধু হুহুই-এর আদিবাসীদের একার নয়। লড়াই ভবিষ্যতের। লড়াই পৃথিবীর জন্য। সফল হবে কিনা সময় বলবে। কিন্তু সীমাহীন উন্নতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা পৃথিবীর অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে আবারও। হুহুই-এর পৃথিবী মরে গেলে কি আধুনিক পৃথিবীটা বাঁচবে?
Powered by Froala Editor