কয়লা খননের জন্য উচ্ছেদ আস্ত শহর, প্রতিবাদ জার্মান পরিবেশকর্মীদের

পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ গোটা অঞ্চল। বুলডোজার, এক্সক্যাভেটর দিয়ে ভাঙা হচ্ছে একের পর এক বাড়ি। চোখের নিমেষেই যেন মুছে যাচ্ছে একটা গোটা শহর। পশ্চিম জার্মানির ছোট্ট গ্রাম লুৎজারথের ছবি বর্তমানে এমনটাই। এমনকি লুৎজারথের মাইল কয়েক দূর থেকে এই দৃশ্য দেখলেও বিস্মিত হয়ে যেতে হয় যে-কাউকেই। যে-কটা ঘর-বাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথা তুলে, তাদের ঘিরে রেখেছে শত ফুট গভীর গর্ত। মনে হবে, গোটা শহরের চারপাশটাই যেন ধ্বসে পড়েছে ভূমিকম্প কিংবা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে।

না, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এই ধ্বংসযজ্ঞের পিছনে রয়েছে মানুষের হাত। আসলে লুৎজারথের (Luthzerath) নিচেই লুকিয়ে রয়েছে পশ্চিম জার্মানির অন্যতম বৃহৎ কয়লা ভাণ্ডার (Coal Mine)। আর এই প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের জন্যই কয়েক হাজার মানুষকে উৎখাত করেছে জার্মান শক্তিসংস্থা ‘আরডব্লুই’ (RWE)। 

তবে লুৎজারথেতে কয়লাখনি নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই কয়লার খনন চলে আসছে এই অঞ্চলে। এমনকি কয়লা খনির আয়ের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল এই শহর। তবে ক্রমশ পরিধি বেড়েছে খননকার্যের। ২০১৭ সালে বাধ্য হয়েই তাই ঘর ছেড়েছিলেন বহু মানুষ। এবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে সেখানে। তবে এবার নির্দিষ্ট কোনো অংশ নয়, বরং গোটা শহরটাকেই মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি। 

২০২১ সালেই এই প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিল আরডব্লুই। সেইসময় থেকেই ধীরে ধীরে বিক্ষোভ শুরু হয় লুৎজারথেতে। স্থানীয়রা তো বটেই, প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন জার্মানির নানা প্রান্তের পরিবেশকর্মীরাও। অন্যদিকে সে-সময় জার্মানিতে আয়োজিত হয় ফেডারাল নির্বাচন। বদল আসে সরকারেও। অনেকেই সে-সময় আশা করেছিলেন বদলাবে লুৎজারথের ভাগ্য। তবে শেষ পর্যন্ত তেমনটা হয়নি। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে আরডব্লুই-কে আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্র দেয় জার্মান সরকার। জানানো হয় ২০৩৮ সাল পর্যন্ত খনন প্রক্রিয়া চলবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে। 

এরপর বাধ্যতামূলকভাবে স্থানীয়দের পুনর্বাসিত করা হলেও, পরিত্যক্ত ঘর-বাড়িগুলির দখল নিয়েছিলেন পরিবেশকর্মীরা। কেউ আবার প্রতিবাদ জানিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন ট্রি হাউসে। আজও যে প্রতিবাদ অবিরত। পরিবেশকর্মীদের দাবি, ২০১৭ সালে কয়লাখনি বন্ধের কথা ঘোষণা করলেও, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করেনি সরকার। পাশাপাশি লুৎজারথে খনি থেকে উত্তোলিত হয় লিগনাইট কয়লা। যা সবচেয়ে বেশি দূষণের জন্য দায়ী। প্যারিস প্রোটোকল অনুযায়ী, এই ধরনের খনি বন্ধ করা উচিত সবচেয়ে প্রথমে। পাশাপাশি পরিসংখ্যানে এও উঠে আসছে, জার্মানিতে বর্তমানে যে পরিমাণ কয়লার চাহিদা রয়েছে, তার থেকেও বেশি পরিমাণ কয়লা উৎপাদিত হয় বর্তমানে। প্রশ্ন থেকে যায়, তা সত্ত্বেও কেন কয়লা খননে জোর দিচ্ছে জার্মান প্রশাসন? 

এই প্রশ্নের জবাবে সরকারের সাফাই একটু অন্যরকম। গত বছর থেকেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে, গোটা বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে শক্তিসংকট। গ্যাস কিংবা পেট্রোলিয়াম তেল— এতদিন পর্যন্ত জার্মানির শক্তি চাহিদা মেটাত মূলত রাশিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে ন্যাটোর প্রাইস ক্যাপ প্রকল্পের কারণে বড়োসড়ো ধাক্কা খেয়েছে এইসকল জ্বালানির আমদানি। আর সেই ঘাটতি পূরণ করতেই এই পদক্ষেপ সরকারের। যদিও বাস্তবে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই এই খনির পরিধিবৃদ্ধির পরিকল্পনা ছিল সরকারের, এমনটাই দাবি পরিবেশকর্মীদের। তবে শুধু জার্মান পরিবেশবিদরাই নয়, সম্প্রতি এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তরুণ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও। কাজেই বলার অপেক্ষা থাকে না, লুৎজারথের এই আন্দোলন জার্মানির সীমা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক চর্চার বিষয়… 

Powered by Froala Editor

Latest News See More