গুগলের চাকরি ছেড়ে ২০০ জলাশয় সংস্কার, ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ চেন্নাইয়ের তরুণের

কেউ ক্রীড়াবিদ, কেউ সঙ্গীতজ্ঞ, কেউ আবার রাজনীতিবিদ বা পরিবেশকর্মী— বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সম্ভাব্য প্রভাবশালী তরুণ ব্যক্তিত্বদের নিয়ে প্রতিবছরই একটি বিশেষ তালিকা প্রস্তুত করে ‘টাইম’ ম্যাগাজিন। ২০২২ সালে ‘নেক্স জেনারেশন লিডারস’-খ্যাত এই তালিকায় গ্রেটা থুনবার্গ, এভেস মৌসল্লাম, মে ভয়েবের মতো পরিবেশবিদদের সঙ্গে জায়গা পেয়েছিলেন এক ভারতীয়ও। অবশ্য গ্রেটাকে নিয়ে এ-দেশের মিডিয়া মাতামাতি করলেও, চর্চার আড়ালেই থেকে গিয়েছিলেন তিনি। 

অরুণ কৃষ্ণমূর্তি (Arun Krishnamurthy)। চেন্নাই-এর সংস্থা ‘এনভায়রনমেন্টালিস্ট ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া’ (Environmentalist Foundation Of India) তথা ‘ইএফআই’-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই সংস্থার মাধ্যমেই মিষ্টি জলের হ্রদ, পুকুর এবং খাল পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অরুণ। এমনকি পরিবেশ নিয়ে কাজ করার জন্য ছেড়েছেন মোটা অঙ্কের কর্পোরেট চাকরিও। 

অরুণের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে। তখন তিন গুগল-এ কর্মরত। তবে ক্রমাগত নগরায়ণ ভাবিয়ে তুলেছিল তাঁকে। দেখেছিলেন, নগরায়ণের জেরে বেমালুম দেশ থেকে উবে যাচ্ছে একের পর এক জলাশয়। একটা সময় দক্ষিণ ভারত-জুড়ে জালের মতো বিস্তৃত ছিল ছোটো বড়ো খালও। সেগুলির অবস্থাও বেশ করুণ। আর সেই কারণেই যে ক্রমাগত বন্যার প্রকোপ বেড়ে চলেছে, তা সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু কে দায়িত্ব নেবে সচেতনতা বৃদ্ধির? কে-ই বা পদক্ষেপ নেবে মজে যাওয়া কিংবা ধুঁকতে থাকা এইসকল জলাশয়কে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার? 

না, সরকার কিংবা প্রশাসনের ওপর ভরসা না করে নিজেই মাঠে নেমেছিলেন অরুণ। দ্বিতীয় কথা না-ভেবেই ছেড়েছিলেন মোটা মাস মাইনের চাকরি। তাঁর কথায়, কর্পোরেট চাকরি যে তাঁর পছন্দ হত না এমন নয়, তবে সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পরিবেশেই তাঁকে কাছে ডেকেছিল।

আসলে পরিবেশের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল ছোটোবেলা থেকেই। প্রথমত গ্রাম্য পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠে অরুণের। পরবর্তীতে মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে তিনি। দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাস কমিউনিকেশনে পড়ার সময় ফটোগ্রাফি এবং ফিল্ম মেকিং-এর জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছেন তিনি। তৈরি করেছেন নদী, বাস্তুতন্ত্র এবং হ্রদের ওপর একাধিক তথ্যচিত্র। এমনকি ২০১০ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়ন এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল ‘কুরমা’ নামের তাঁর একটি ছবি। যা নির্মিত বিলুপ্তপ্রায় এক সামুদ্রিক কচ্ছপের ওপর। এই সবকিছুই যেন নতুন করে পরিবেশের কাছে ফিরিয়ে এনেছিল তাঁকে। 

প্রাথমিকভাবে একা কাজ করলেও, ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় তাঁর সংগঠন। ক্রমে সেখানে যোগ দেন বহু স্বেচ্ছাসেবক। যাঁরা সকলেই আদতে ছাত্র-ছাত্রী। বর্তমানে সবমিলিয়ে দেশের ১৯টি রাজ্যে পৃথক পৃথকভাবে শাখা রয়েছে এইএফআই-এর। সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮২ হাজার। এখনও পর্যন্ত দেশের ১৯৫টিরও বেশি জলাশয়কে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছেন অরুণ। এই ধরনের জলাশয়ের গুরুত্ব নদীর থেকেও বেশি বলেই অভিমত তাঁর। কারণ, প্রবাহ না থাকায় দূষণ কিংবা বিষক্রিয়ার শিকার হলে সহজেই তা সারিয়ে উঠতে পারে না হ্রদ বা বড়ো ঝিল। আর তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে বাস্তুতন্ত্রে। 

তবে শুধু হ্রদ কিংবা জলাশয় সংস্কারই নয়, একইসঙ্গে সচেতনতা বাড়াতেও ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তরুণ পরিবেশবিদ। লক্ষ্য, ভারতের স্কুলপড়ুয়া খুদেদের কাছে পৌঁছে যাওয়া। পরবর্তী প্রজন্মকে সচেতন না করলে, পরিবেশের হাল ফিরবে না বলেই অভিমত অরুণের। সেই কারণেই হয়তো ‘ভবিষ্যতের নায়ক’ হিসাবেই তাঁকে বেছে নিয়েছে ‘টাইম’ পত্রিকা…

Powered by Froala Editor