অর্থই অনর্থ : শিবরাম-শরৎচন্দ্র দ্বন্দ্ব এবং শিশির ভাদুড়ির বক্তব্য

অর্থকষ্ট ছিল নিত্যসঙ্গী। সারাটা জীবন কেটেছে দারিদ্র্যের সঙ্গে ঘর করে। মৃত্যুর পর তাঁর বেওয়ারিশ লাশ পড়েছিল পিজি হাসপাতালের মর্গে। অথচ কথার ফুলঝুরিতে মাতিয়ে রেখেছিলেন বাংলা সাহিত্যকে। মানুষকে হাসানোর দায়িত্ব কি চাট্টিখানি কথা! হাসিমুখে উড়িয়ে দিতেন সমস্ত কষ্টকে। নামের মধ্যেই আছে ‘শিব’ আর ‘রাম’—তবে আর চিন্তা কীসের! কিংবদন্তির আরেক নাম শিবরাম চক্রবর্তী (Shibram Chakraborty)। তাঁর রসিকতা, অর্থাভাব আর বোহেমিয়ানা নিয়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র গল্প। 

তার মধ্যে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে গোলযোগের ঘটনাটা তো বহুচর্চিত। শিবরাম সেখানে ‘ট্রাজিক নায়ক’। কিন্তু গল্পের মধ্যেও তো গল্প থাকে। ফলে একবার উল্টেপাল্টে দেখে নেওয়া যাক শিশিরকুমার ভাদুড়ির (Sisir Kumar Bhaduri) বক্তব্যও। এই গল্পের মাঝখানে আছেন তিনিই। তাঁর থিয়েটারে অভিনীত নাটকের মালিকানা নিয়েই যত গণ্ডগোলের সূত্রপাত। 

প্রচলিত গল্পটি কীরকম? ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (Sarat Chadra Chattopadhyay) বিখ্যাত উপন্যাস ‘দেনাপাওনা’। সেটারই নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম। নাম রাখেন ‘ষোড়শী’। শিশিরকুমার ভাদুড়ি তখন বাংলার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। থিয়েটারের নতুন যুগের দিশারী। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদধন্য। সেই নাটক অভিনীত হল ১৯২৭ সালে। বিরাট সাফল্য পেল ‘ষোড়শী’, হাউসফুল চলছে প্রতিটি শো। অথচ নাট্যকার রূপে খ্যাতি পাচ্ছেন শরৎচন্দ্র। ‘ভারতী’ পত্রিকাতেও তাঁর নামেই উপন্যাসের নাট্যরূপ ছাপা হয়েছে। শিবরামের নাম কোথাও নেই। 

লজ্জার মাথা খেয়ে শিবরাম গেলেন শিশিরবাবুর কাছে। যদি অভিনয়ের লভ্যাংশের কিছু টাকা পাওয়া যায়, তাহলে অর্থাভাবের একটু সুরাহা হয়। শো শেষে শিশিরকুমার জানালেন, টিকিট বিক্রির সব টাকা শরৎচন্দ্র এসে নিয়ে গেছেন। শিবরামের সমস্যার তাঁকে বলা হয়েছিল। কিন্তু শরৎচন্দ্রের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল যে টিকিট বিক্রি হয়েছে তাঁর নামে, এখানে শিবরাম আসছে কোথা থেকে? আর শিবরামের তো ঘর-সংসার নেই, বিয়ে-থা করেনি, টাকা দিয়ে সে কী করবে?

আরও পড়ুন
মন্দির-মসজিদ নয়, সর্বধর্ম সমন্বয়ের জন্য পায়খানা বানানোর কথা লিখেছিলেন শিবরাম

কথার জাদুকর শিবরামের মুখেও তখন শব্দ জোগায়নি। সহানুভূতি আর অনুশোচনা থেকে শিশিরকুমার নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা দিয়েছিলেন মাত্র একশো কুড়ি টাকা। সেটুকু নিয়েই ফিরলেন শিবরাম। শরৎচন্দ্র এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও শিশির ভাদুড়ি কিন্তু পরে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন। 

আরও পড়ুন
মৃত্যুর পরে 'বেওয়ারিশ' শিবরাম, চালান হয়েছিলেন মর্গেও

তাঁর মতে, ‘দেনাপাওনা’-র নাট্যরূপ নিয়ে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল ১৯২৩ সালেই। পরিকল্পনা অবশ্য এগোয়নি। পরে শিবরাম উপন্যাসটির একটি নাট্যরূপ নিয়ে দেখা করেন শিশিরকুমারের সঙ্গে। সেটা দেখে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি তিনি। মনে হয়েছিল, উপন্যাসের মূলভাবটি তাতে নেই। শিবরাম তখন ‘ভারতী’ পত্রিকায় সেটি ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। পত্রিকার সম্পাদক সরলা দেবী আইনি জটিলতার কারণে নাট্যরূপটি নিয়ে যান শরৎচন্দ্রের কাছে। তিনি নাটকটিকে পরিবর্তন করে তবে ছাপানোর অনুমতি দেন। বজায় থাকে শিবরামের দেওয়া ‘ষোড়শী’ নামটিই। আর সাম্মানিক পান তিনশো টাকা। 

শরৎচন্দ্রের কাছে ‘ভারতী’র প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া থেকে তাঁকে রাজি করানো—পুরোটাই শিবরাম একা হাতে করেছিলেন। ফলে আশা ছিল, কিছু টাকা অন্তত পাবেন। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও ভালো ছিল। কিন্তু ফিরতে হল খালি হাতে। ভুল বুঝতে পেরেছিলেন শিশিরকুমারও। শরৎচন্দ্রকে তিনি ভালো মতোই চিনতেন। শিবরাম যে টাকা পাবেন না, সেটাও জানতেন। কিন্তু ‘ষোড়শী’-র সাফল্যের পর তো আর শরৎচন্দ্রকে চটানো যায় না! পরে অবশ্য আক্ষেপ করে বলেছিলেন,
 “শরৎদা জানতেন শিবরামের তখন টাকার খুব দরকার ছিল। তিনি কিন্তু জীবনে কাউকে একটি পয়সাও ছাড়েননি; মৃত্যুর পরেও শরৎদা তাঁর বইয়ের রয়্যালটির হিসেব করেছেন বসে বসে।”

শরৎচন্দ্র সম্পর্কে কোনো খারাপ কথা শিবরাম উচ্চারণ করেননি, কিন্তু হতবাক হয়েছিলেন তাঁর আচরণে। নষ্ট হয়ে গেছিল শ্রদ্ধার জায়গাটিও। তবে শিশিরকুমারকে বিঁধতে তিনি ছাড়েননি। তাঁর মদ্যপানের প্রবণতা নিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ঢং-এ বলেছিলেন, “উনি শিশি-র ভাদুড়ী নন, বোতলের ভাদুড়ি”। অন্যদিকে শরৎচন্দ্রের সাহিত্যে ঝড়ে পড়ছে দরিদ্র মানুষদের প্রতি সহানুভূতি। তিনি কলম ধরেছিলেন সংসারে যাঁরা শুধু দিয়েই গেলেন, বদলে পেলেন না কিছুই, তাঁদের জন্য। ‘ষোড়শী’-র টাকা আত্মসাৎ করার সময় তাঁর কি শিবরামের মুখটি একবারও মনে পড়েনি?

তথ্যসূত্র :
চকরবর্‌তি, বিনোদ ঘোষাল, আনন্দবাজার অনলাইন, ৯ জুলাই, ২০১৬
বাংলা থিয়েটার ও নাট্যাচার্য শিশিরকুমার, অনিল মুখোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor