শীতকালে চালিয়ে রাখা হয় গাড়ির ইঞ্জিন, পৃথিবীর ‘শীতলতম’ শহরের দস্তুর এমনই

এমনিতে অন্য যে কোনো শহরের মতোই মনে হতে পারে। শুধু শীতের সময় গোটা শহরটা বরফে ঢেকে যায়। তখন রাস্তায় কাউকে দেখা যায় না একেবারেই। অথচ হঠাৎ লক্ষ্য করতে পারেন, সমস্ত গাড়ির ইঞ্জিন (Car Engine) চালু করা রয়েছে। যেন রাস্তার ধারে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে রয়েছে সমস্ত গাড়ি। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো যাত্রী নেই। এমন একটা দৃশ্য চোখে পড়লেই আন্দাজ করে নেবেন, আপনি এসে পড়েছেন ওয়মিওকন শহরে (Oymyakon)। পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলে মানুষের স্থায়ী বসতি রয়েছে, তার মধ্যে ওয়মিয়কন শীতলতম (Coldest Inhabitat)। শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা এতটাই নেমে যায়, যে গাড়ির ইঞ্জিন একবার বন্ধ করলে আর চালু করা যায় না।

স্কুলপাঠ্য ভূগোল বইতে হয়তো অনেকেই পড়েছিলেন ওয়মিয়কনের কথা। অথবা ভারখয়ানক্স শহরের কথা। রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলে পাশাপাশি অবস্থিত এই দুই জনপদের মধ্যে চলে পারদ নামানোর লড়াই। দুই এলাকাতেই শীতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্র নেমে যায় -৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। তবে সমস্ত রেকর্ড বিচার করে এখনও ওয়মিয়কনই এগিয়ে রয়েছে প্রতিযোগিতায়। তবে এটুকু বর্ণনা পড়ে হয়তো অনেকেই ভেবে বসবেন, সভ্য নাগরিক মানুষের বুঝি পা পড়েনি এই গ্রামে। এখানে হয়তো প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে কয়েক হাজার বছর ধরে টিকে রয়েছে কোনো উপজাতি।

বিষয়টা একেবারেই তেমন নয়। ওয়মিয়কন গ্রামের জনবসতি কিছুতেই এক শতাব্দীর চেয়ে বেশি পুরনো নয়। ১৯২০ সাল নাগাদ সাইবেরিয়ার একদল শিকারী শীতকালে ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিলেন এখানে। আশেপাশে পান করার মতো একটুও জল যখন পাচ্ছিলেন না, তখন এই ওয়মিয়কন গ্রামে বরফের নিচে চাপা পড়ে থাকা জলের সন্ধান পান। ওয়মিয়কন নামকরণও সেইজন্যই। রুশ ভাষায় এর অর্থ, যে জল কখনও বরফে পরিণত হয় না। তবে আসলে এখানকার জল এত তাড়াতাড়ি জমে বরফে পরিণত হয়, তার নিচের উষ্ণতা বেরিয়ে যাওয়ার সময়টাও পাওয়া যায় না।

ওয়মিয়কন গ্রামের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি অতিকায় ষাঁড়ের মূর্তি। আর তার নিচে লেখা একটি রেকর্ড। ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাস। সেবছর ওয়মিয়কনের তাপমাত্র নেমে গিয়েছিল – ৭১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তবে এই পরিমাপ গ্রামবাসীরাই করেছিলেন। আবহাওয়া দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী গ্রামের রেকর্ড উষ্ণতা –৬৭.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের। ১৯৩৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল সেই রেকর্ড তৈরির দিন।

আরও পড়ুন
-৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও স্বাভাবিক জনজীবন, পৃথিবীর শীতলতম গ্রামের গপ্পো

তবে এতকিছুর পরেও ওয়মিয়কন গ্রামে একসময় অন্তত আড়াই হাজার মানুষের বাস ছিল। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল সেনাছাউনিও। সেইসময় তৈরি একটি অস্থায়ী বিমানবন্দরের কিছু টুকরোও এখনও ছড়িয়ে রয়েছে। তবে মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। অবশ্য সেটাই তো স্বাভাবিক। ওয়মিয়কন এমন একটা গ্রাম, যার সবচেয়ে কাছের শহরের চেয়ে কাছে রয়েছে উত্তরমেরুবৃত্ত। শুধু তাই নয়, শীতকালে এখানে দিনের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় মাত্র ৩ ঘণ্টা। আর ২১ ঘণ্টা ধরে থাকে অন্ধকার রাত। সেই হিমশীতল রাতে রাশিয়ার বিখ্যাত ভদকাই মানুষের শরীর গরম রাখার একমাত্র পথ। তাতে জল মেশানোর অবশ্য কোনো উপায় নেই। কারণ সমস্ত জল জমে বরফ হয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, সবসময় ঢেকে রাখতে না পারলে বোতলের মধ্যে ভদকাও বরফে পরিণত হয়। এমন হাজারো ঝঞ্ঝাট নিয়ে অনেকেই থাকতে চাইছেন না। ওয়মিয়কনে গ্রামবাসীর বর্তমান সংখ্যা তাই ৯০০ জনেরও কম। কেউ কেউ রয়ে গিয়েছেন বাধ্য হয়ে। আবার কেউ কেউ রয়ে গিয়েছেন এক আশ্চর্য স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে।

আরও পড়ুন
৩০,০০০ বছরেরও প্রাচীন গুহাচিত্র উদ্ধার সাইবেরিয়ায়

Powered by Froala Editor