গুপ্তচরবৃত্তি থেকে তাপমাত্রা নির্ণয় - ‘মুশকিল আসান’ হয়ে উঠেছিল ফিনফিনে ঘুড়িই

“পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা 

আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক মাটিতে অবজ্ঞা” 

এত ঘুড়ির ঝাঁক দেখতে দেখতে একটা কিশোর হারিয়ে যাচ্ছে। সে নিজেও তখন সুতোয় ভর করে আকাশে পাড়ি দিচ্ছে। বাস্তবিকই, এক একটা ছোটবেলা যেন উড়ে যায় ঘুড়ির সঙ্গে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটি এগিয়ে এলে লাইন লাগে ঘুড়ির দোকানে। সুতো, মাঞ্জা; সেইসঙ্গে বেছে নেওয়া ভালো অস্ত্রটি। আকাশে উড়লে যেন যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসতে পারে। ‘যুদ্ধ’ শব্দটির ব্যবহার কি ঠিক হল? ঘুড়ির হাত ধরে যে আসলে আমরাও উড়ি। ওড়ে আরও অনেক প্রজন্ম।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি নিছক এক বিনোদনের জিনিস। ছাদে জড়ো হয়ে ‘ভোঁকাট্টা’-র উল্লাসই আলাদা। কিন্তু একটু পেছন দিকে গেলে দেখা যাবে, ঘুড়িকে নানা সময় নানা কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। বেঞ্জামিল ফ্র্যাঙ্কলিনের ঘুড়ি উড়িয়ে বিদ্যুৎ গবেষণা তো আজ কিংবদন্তির পর্যায়। তবে এই জিনিসটি কিন্তু নবীন নয়; বরং বেশ প্রবীণ। যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ২৮০০ বছর আগে থেকেই চিন দেশে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হয়। কাগজের পাশাপাশি তখন সিল্কের কাপড় দিয়েও ঘুড়ি বানানো হত। পরে সেই প্রথা চিনা গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র… 

আরও পড়ুন
অবহেলায় দুদিন ঝুলে ছিল ডাকবাক্সেই, ব্রিটেনে উদ্ধার মহাত্মা গান্ধীর ব্যবহৃত চশমা

সেই প্রাচীন সময় থেকেই বিনোদন ছাড়াও আরও একটি ব্যবহার দেখা গেছে ঘুড়ির মধ্যে— গুপ্তচরবৃত্তি। জাপান এবং চিনে ঘুড়ির গায়ে কিছু লিখে উড়িয়ে দেওয়া হত। শত্রুপক্ষের আসার আগেই যাতে বাকি সাথীরা খবর পেয়ে যায়, সেজন্য ব্যবহার করা হত এটি। অনেক সময় গুপ্ত সংকেতও প্রেরণ করা হত। জাপানে অবশ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এই ঘুড়িকে নিয়ে আসে। এই জিনিসটা বৌদ্ধ সাধুদের ধর্মীয় আচরণের অংশ হয়ে ওঠে। ঘুড়ি তাঁদের কাছে হয়ে যায় ‘তালিসমানস’; যা অশুভ শক্তিকে দূর করে। এইভাবেই তাঁদের সমাজের মধ্যে ঘুড়ির অন্য একটি ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। 

সময় সুযোগ পেলেই বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়ে যাই আমরা। কখনও ভেবে দেখেছি কি, যে ঘুড়ি দিয়েও মাছ ধরা যায়? মাইক্রোনেশিয়ার মানুষরা একটি বিশেষ ঘুড়ি ব্যবহার করত টোপের অংশ হিসেবে। সেটা ব্যবহার করেই চলত মাছ ধরা। প্রধানত এশিয়ার বিভিন্ন দেশেই ঘুড়ির প্রচলন ছিল শুরুতে। ভারতেও মুঘল আমল থেকে বিনোদনের একটি অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল ঘুড়ি ওড়ানো। আর বনেদি কলকাতায় তা ছিল বাবুয়ানি দেখানোর এক উৎসব। ১৩-র শতকে মার্কোপোলোর হাত ধরে ইউরোপে এসে পৌঁছয় জিনিসটি। এবার এর ব্যবহারের পরিসর যেন আরও খানিক বৃদ্ধি পায়। 

আরও পড়ুন
চিড়-ধরা যৌথ পরিবার, একটা ছাদ ও ঘুড়ির আত্মীয়তা

সামান্য বিনোদনের জিনিসও মানুষের হাতে নানা রূপে বদলে যায়। অনেক সময় ধ্বংসাত্মক রূপও নিয়ে নেয়। যে ঘুড়ি আকাশে ওড়ে মুক্তির জন্য, সেই ঘুড়িকেই ব্যবহার করা হয়েছিল যুদ্ধের কাজে। প্রাচীনকালে চিনে যুদ্ধের সময় ঘুড়িতে বিস্ফোরক বেঁধে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হত। দুই বিশ্বযুদ্ধেই ঘুড়ির সংকেত পাঠানোর কাজ করত। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখেছিল আরও অন্য কিছু। সেখানে এমন ঘুড়ি তৈরি করা হয়েছিল, যা মানুষকে তুলতে পারে। একইসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিও সংকেত পাঠানোর কাজেও ঘুড়ি ব্যবহার করা হত। একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে বিজ্ঞানের শুভ দিক। গবেষণার কাজেও নিরন্তর সাহায্য করেছে ঘুড়ি। ১৭৪৯ সালে দুই বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার উইলসন এবং টমাস মেলভিন একটি পরিকল্পনা করেন। ঠিক করেন পৃথিবীর অপরের স্তরের তাপমাত্রা মাপবেন। একটা ঘুড়ির গায়ে লাগালেন থার্মোমিটার। তারপর সেটাকে ভাসিয়ে মেপে নিলেন তাপমাত্রা। কিংবা ধরা যাক নায়গ্রা ফলসের ওপর ঝুলন্ত সেতুর কথা। দড়ি দিয়ে তৈরি মইকে জলপ্রপাতের একদিক থেকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে ঘুড়িই কিন্তু সাহায্য করেছিল।  

এত ব্যবহারের মাঝেও সেই আদি অকৃত্রিম পদ্ধতিটি লেগে আছে গায়ে। পাড়া জুড়ে মাঞ্জা দেওয়া, ঘুড়িগুলোকে তৈরি করা, তারপর লেগে পড়ো লড়াইয়ে। এই লড়াই বন্ধুত্বের, মিলনের। ঘুড়ির অদৃশ্য দূরত্বই স্বপ্ন তৈরি করছে। আর নিচ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ছোট্ট ছেলেটা। কাটা ঘুড়িটা সবার আগে ধরতে হবে না! 

Powered by Froala Editor

More From Author See More