মহালয়া ছিল পিতৃতর্পণের তিথি, মহিষাসুরমর্দিনীর হাত ধরে নবজন্ম দিনটির

বাঙালির জীবনে কয়েক দশক আগেও মহালয়া দিনটিকে ঘিরে এমন তীব্র উদ্দীপনার সমারোহ ছিল না। এইদিন ভোরে ধর্মপ্রাণ মানুষের দল গঙ্গার ঘাটে ভিড় জমাতেন পিতৃতর্পণের উদ্দেশে। পরদিন শুক্লা প্রতিপদ, অনেক বারোয়ারিতলাতে সেদিনই দেবীর বোধন, তাই একটা সাজো-সাজো রব, খুশি-খুশি হাওয়া সেদিন থেকেই থাকত। ব্যাস, এটুকুই। 

পিতৃগণ, অর্থাৎ বিগত পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধতর্পণের জন্য নির্দিষ্ট সময়টিই হচ্ছে পিতৃপক্ষ, যার চূড়ান্ত দিন অমাবস্যা। এই অমাবস্যারই নামান্তর মহালয়া। সেদিন পিতৃপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের শুরু।

কিন্তু, একসময়ে ছবিটা বদলে গেল আকাশবাণীর এক প্রভাতী অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে। তার নাম 'মহিষাসুরমর্দিনী'। সেবার আকাশবাণীর আড্ডায় এসে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ওরফে বুড়োদা (যিনি তখন বেতারজগত পত্রিকার সম্পাদকও বটে) সংস্কৃত শ্লোক আর নতুন গানের সমন্বয়ে এক অভিনব প্রভাতী অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিলেন। কথাটা বাণীকুমার সহ সকলেরই বেশ মনে ধরল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বললেন, "পুজো আসছে আর মাসখানেক বাদে, প্রতি বছর পুজোর সময় আমি এক জায়গায় ঠাকুরের সামনে ব'সে ব'সে চণ্ডীপাঠ করি- খানিকটা সড়োগড়ো আছে। শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনি নিয়ে যদি বেশ গানটান, শ্লোক লাগিয়ে একটা প্রোগ্রাম করা যায়...।" সক্কলে কথাখানা লুফে নিলেন।

তবে একজন সমালোচক খুঁত ধরতে গেলেন, কায়স্থের ছেলে চণ্ডীপাঠ করলে লোকে সেটা ভালোভাবে মেনে নেবে তো? প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার মহাশয় মন্দ্র কণ্ঠে বলে উঠলেন, "প্রোগ্রাম করবে তার আবার বামুন কায়েত কী হে? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? তাহলে এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে তারা তো অর্ধেক মুসলমান, খুশি মহম্মদ, আলি, মুন্সী সবাই তো বাজাবে, তাহলে তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়। তা ছাড়া আমরা একটা বিরাট উৎসবের আগে ভূমিকা হিসেবে এই প্রোগ্রাম করব- এতে কার কী বলার আছে?..."

স্তব্ধ হয়ে গেল সমালোচকের মুখ। বাণীকুমার হেসে বললেন, "বটেই তো। ও-সব কথা ছেড়ে দিন-না - আমি বীরেন ছাড়া কাউকে চণ্ডীপাঠ করতেই দেব না।" 

প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। হপ্তাখানেকের মধ্যে বাণীকুমার কতকগুলো গান লিখে ফেললেন। সেসবে সুর দিতে লাগলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী, রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক। "শান্তি দিলে ভরি" গানটিতে সুর দিলেন সাগির খাঁ। "অখিল বিমানে", "বিমানে বিমানে আলোকের গানে" প্রভৃতি গানের সুর হরিশ বালীর দেওয়া। "মাগো তব বীণে সঙ্গীত প্রেম ললিত" প্রভৃতি গানে সুর দিলেন পঙ্কজকুমার, রাইচাঁদ বড়াল সুরারোপ করলেন "নিখিল আজি সকল ভোলে" গানটিতে। 

আরও পড়ুন
পৌঁছতে পারেননি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, আকাশবাণীতে সেবার স্তোত্রপাঠের দায়িত্বে নাজির আহমদ?

বিরাট এক অর্কেস্ট্রার আয়োজন হল, সেকালের সবচেয়ে বড়ো বাজিয়েরা গানের সঙ্গে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন। সারেঙ্গি ধরলেন মুন্সী, চেলো বাজালেন তাঁর ভাই আলী, হারমোনিয়ামে খুশি মহম্মদ, দ্বিতীয় বেহালা তারকনাথ দে, মান্ডোলিন সুরেন পাল, গিটার সুজিত নাথ, এসরাজ দক্ষিণামোহন ঠাকুর, ডবল বাস্ শান্তি ঘোষ, বেহালা অবনী মুখোপাধ্যায়, পিয়ানো রাইচাঁদ বড়াল- আর কত নাম করা যায়! প্রধান গায়ক পঙ্কজকুমার মল্লিক স্বয়ং, এছাড়া বিমলভূষণ, কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী, মানিকমালা, প্রফুল্লবালা, বীণাপাণি, প্রভাবতী সহ সেকালের শ্রেষ্ঠ গাইয়েরা কোরাসে অংশ নিলেন। পরে এই অনুষ্ঠানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ তাবড় তাবড় শঙ্গীতশিল্পীরা যোগ দিয়েছিলেন। কী করে সমস্ত অনুষ্ঠানটি সুরে বাঁধা হয়ে গেল, সেও এক আশ্চর্য ইতিহাস। 

কথা ছিল যে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যখন সংস্কৃত শ্লোক সুরসহযোগে আবৃত্তি করবেন, সেই সময় যন্ত্রীরা তাঁকে সুর দিয়ে সাহায্য করবেন শুধু। তারপর তিনি যখন বাংলা গদ্য পাঠ করবেন, সে সময় তাঁরা ধীরে ধীরে আবহসঙ্গীত হিসাবে কোনও রাগ আলাপ করবেন। রাইচাঁদ বড়াল মহাশয় যন্ত্রীদের সে কথা বেশ করে বুঝিয়ে দিলেন। 

যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হল। বীরেন ভদ্র শ্লোকাবৃত্তি করে, একটু থেমে বাংলা গদ্য আবৃত্তি আরম্ভ করলেন, "আজ শুভ শারদ উৎসব, জলে, স্থলে প্রকৃতিতে আনন্দের বার্তা..."

আরও পড়ুন
বৃষ্টিভেজা শ্রাবণে প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ, শেষযাত্রার ধারাবিবরণী দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

ওদিকে সংস্কৃত শ্লোক ও বাংলা গদ্যের পার্থক্য বুঝতে না পেরে উর্দুভাষী মুসলমান বাদকবৃন্দ ঠিক বীরেনবাবুর অনুরূপ কথার সুরে বাজনা বাজিয়ে চললেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেখলেন, এ তো মন্দ শোনাচ্ছে না! তখন তিনি সামান্য সুর রাখলেন গদ্যে, সেটি আরও চমৎকারভাবে মিলে গেল তাঁদের সুরের সঙ্গে। রাইচাঁদ বড়াল, নৃপেন মজুমদার, পঙ্কজ মল্লিক সবাই সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন, ভাবতে লাগলেন, এরা করে কী! কিন্তু ব্যাপারটা ভালো লাগছিল সবারই- কিছুক্ষণ করে বাঙালি যন্ত্রীরাও সুর ভিড়িয়ে দিলেন, তারপর সে সুরে ভিড়ে গেল গান, আবার আবৃত্তি। সমস্ত জিনিসটা একটা অখণ্ড সুরের প্রবাহে বইতে লাগল। দু'ঘন্টা ধরে এই অনুষ্ঠান মাতিয়ে তুলল সকলকে। তারপর বেতার অফিসে যে কী অজস্র অভিনন্দন আসতে শুরু করল, তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব!

নৃপেন মজুমদার খুশিতে ভরপুর হয়ে বলে উঠলেন, "এ কারুর কৃতিত্ব নয়- সবই মায়ের খেলা ভাই- মা দুর্গা স্বয়ং যেন পেছন থেকে এসে আমাদের অনুষ্ঠানটিকে সুরে বেঁধে দিয়ে গেলেন।" 

হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সকল শিল্পীর মিলিত প্রচেষ্টায় 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানটি বৈচিত্র্যেড় ও জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থান দখল করল।

আরও পড়ুন
নব্বইয়ের মহালয়া, রেডিও নয় তবু নস্টালজিয়া

প্রথম দু'বছর অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল ষষ্ঠীর প্রভাতে, ভোর চারটের সময়। পরে শ্রোতাদের অনুরোধে একে নিয়ে আসা হল মহালয়ার প্রভাতে। এইভাবে সতেরো-আঠেরো বছর বেশ কেটে যাওয়ার পর, আবার আর একদল গোঁড়া মানুষজন ধুয়ো তুললেন, ওই দিন পিতৃপক্ষ, দেবীর বন্দনা ওই দিন করা ঠিক নয়। তিথি অনুসারে এই অনুষ্ঠান করতে হবে। রেডিও কর্তৃপক্ষ আবার তিথি অনুসারে দু-তিন বছর অনুষ্ঠান সম্প্রচার করলেন, কিন্তু তাতে বহু শ্রোতার দিক থেকে এলো প্রতিবাদ।

অধিকাংশ শ্রোতা বললেন, প্রথমত এই অনুষ্ঠানের ধর্মীয় মূল্য কতখানি তা আমাদের জানা নেই, তবে চিত্তাকর্ষক শারদীয়া উৎসবের একটা অঙ্গ হিসাবে আমরা একে গ্রহণ করে থাকি। বেতার আমাদের ধর্মে দীক্ষা দিতে আসেনি, এসেছে আনন্দ দিতে। তা ছাড়া, দেবীর বোধন তো অনেক আগেই কৃষ্ণানবমী তিথি থেকেই শুরু হয়ে যায়, তাহলে মহালয়ার প্রভাতে দেবীবন্দনামূলক অনুষ্ঠান করলে ক্ষতিটা কোথায়?

শ্রোতাদের আগ্রহ ও বিশেষ অনুরোধে পুনরায় মহালয়ার প্রভাতেই এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারের রীতি প্রবর্তিত হল। সেই ট্রাডিশন আজও চলেছে অবিরাম। 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে গেছে মহালয়ার নাম।

আজও, প্রতি মহালয়ায়, বাঙালির ঘরে ঘরে বেজে ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কালজয়ী কণ্ঠ, "আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর..."

Powered by Froala Editor