কয়েক সেকেন্ড আগে পর্যন্তও তিনি সাবলীলভাবে কথা বলছিলেন আপনার সঙ্গে। তারপর হঠাৎ করেই বদলে গেল তাঁর অভিব্যক্তি। বদলে গেল কণ্ঠও। পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির গলায় তখন ফুটে উঠছে শিশুসুলভ আধোস্বর। ঠিক যেন প্রথমবার আপনাকে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে ছোট্ট কিশোরী।
অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? না, কোনো কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। বরং, এই গল্প বাস্তবের। কথা হচ্ছে টেক্সাসের রিচার্ডসনের বাসিন্দা পাউলাকে (Paula) নিয়ে। তবে শুধু পাউলা বললে ভুল হবে খানিকটা। কারণ, তিনিই কখনো সিন্থিয়া; কখনো আবার জোসেফ; কখনো মেলিন্ডা, জোনাথন, সিক্রেট, টেডি ক্লেয়ার, ফ্রিডম, মিস ভি। না, এই একটিও তাঁর ডাক নাম নয়। এঁরা প্রত্যেকেই পৃথক পৃথক ব্যক্তি।
ঘেঁটে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই? সেটাই স্বাভাবিক। পারতপক্ষে পাওলা একটি বিরল রোগে আক্রান্ত। যার নাম ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার (Disassociative Identity Disorder) বা ডিআইডি (DID)। সহজ ভাষায় বলতে গেলে বহুব্যক্তিত্ব। সব মিলিয়ে পাওলার শরীরে ‘বাস’ করে ১৫ জন! তার মধ্যে কেউ যুবক, কেউ প্রৌঢ়, কেউ আবার ছোট্ট কিশোরী। বলতে গেলে পাউলার শরীরটা যেন হোস্ট। আর পরজীবীর মতো সেখানে জায়গা করে নিয়েছে একাধিক মানুষ। তাঁদের প্রত্যেকের আচরণ, পরিচয় সবকিছুই ভিন্ন। প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। মনস্তত্ত্বের পরিভাষায় যাকে বলা হয় অল্টার।
পাওয়ার বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। বাড়িতেই আত্মীয়দের কাছে যৌন নির্যাতনের শিকার হন পাওলা। তাঁর মধ্যে যে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে রয়েছে, সেইসময়ই তা প্রথম জানতে পারেন পাওলা। সেসময় পাওলাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর আর একটি অল্টার মেলিন্ডা। তাঁর বয়স আজও থমকে রয়েছে পাঁচ বছরেই। মেলিন্ডাই সে-সময় আত্মরক্ষা করতে লুকিয়ে পড়েছিলেন কাবার্ডের ভেতরে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। আজ এত বছর পরে এসেও সেই যৌন নির্যাতনের স্মৃতি বিন্দুমাত্র মনে নেই পাওলার। অথচ, তাঁর শরীরে মেলিন্ডার ব্যক্তিত্ব ফিরে এলেই জেগে ওঠে সেই দগদগে ক্ষত।
আরও পড়ুন
মানসিকতায় বদল, কন্যাসন্তান দত্তক নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বিহারে
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একে একে বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যক্তিত্বের সংখ্যাও। তাঁরা কেউ নরম স্বভাবের, কেউ আবার প্রচণ্ড হিংস্র। তাঁরা কে কখন পাওলার শরীরে ‘ভর’ করবেন তা নিজেও জানেন না তিনি। হয়তো তিনি ঘুমাতে গেলেন মেলিন্ডা হয়ে। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর জাগল জোনাথন। আবার কখনো অল্টার পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া হয় সজ্ঞানেই। কারোর সঙ্গে কথা বলার সময় বা কোনো কাজ করতে করতেই। অনেক সময় আবার একইসঙ্গে একাধিক চরিত্রের আবির্ভাব হয় তাঁর মধ্যে। মাথার ভেতর নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালিয়ে যান তাঁরা। দ্বন্দ্বও বাঁধে একে অপরের মধ্যে। কেউ হয়তো পাওলার অজান্তেই লুকিয়ে রেখে দেন তাঁর বই-খাতা। তবে তাঁর প্রতিটি অল্টারের মধ্যে মিল একটাই। একদিক থেকে দেখতে গেলে তাঁরা সকলেই পাওলার শুভাকাঙ্ক্ষী। পাওলার জীবনের কোনো না কোনো ট্রমাকে, তাঁরা নিজের করে নিয়েছেন শুধুমাত্র পাওলাকে রক্ষা করার জন্য।
আরও পড়ুন
'উল্কি দিয়ে যায় চেনা', মানসিক ভারসাম্যহীনদের শনাক্ত করতে নিদান বোম্বে হাইকোর্টের
পাওলা বর্তমানে টেক্সাসের ‘দ্য কলিন এ রস ইনস্টিটিউট অফ সাইকোলজিক্যাল ট্রমা’-র অধ্যাপিকা। তিনি নিজেও সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল ডিআইডি সম্পর্কে। কিন্তু এই রোগের কোনো সমাধান নেই, তাও জানেন পাওলা।
আরও পড়ুন
মানসিক শান্তি পেতেই ‘অজ্ঞাতবাস’, ৫ মাস পরে তাঁবুতে হদিশ মহিলার
বেশ কয়েক বছর আগে তাঁকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক জঁ কিমব্রো। সবাই না হলেও ‘দ্য উইম্যান উইথ ফিফটিন পারসোনালিটি’-খ্যাত সেই তথ্যচিত্রটিতে ধরা পড়েছে পাওলার একাধিক অল্টাররা। তবে সবমিলিয়ে তাঁর অল্টারের সংখ্যাটা ১৫-ই কিনা— তা স্পষ্ট নয় আজও। পাওলা নিজেও জানেন না, এই মধ্যবয়সে এসেও হঠাৎ কোনো নতুন চরিত্রের আবির্ভাব হবে কিনা তাঁর মধ্যে! অদ্ভুত এই মনস্তত্ত্বের খেলা যেন মনে করিয়ে দেয় অতিপ্রচলিত সেই লোকগীতির কথাগুলোকেই। “তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা মন জানো না…” মনোবিদ হয়েও সত্যিই তা জানা নেই পাওলারও।
Powered by Froala Editor