জাদুঘরে কৃত্রিম কয়লাখনি, নেপথ্যে ছিলেন সমর বাগচী

ঝুলিতে নেই বিএড ডিগ্রি। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনোদিন শিক্ষকতা বা অধ্যাপনাও করেননি কোনো স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তা সত্ত্বেও বাংলার অন্যতম ‘আধুনিক’ শিক্ষকদের তালিকাতে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। ‘আধুনিক’ বলার কারণ, পুথিগত বিদ্যার বাইরে গিয়ে হাজার হাজার কিশোর-কিশোরীকে বিজ্ঞান চিনতে শিখিয়েছিলেন তিনি। বিজ্ঞানকে আগ্রহী করে তুলতে কীভাবে পড়ানো উচিত ছাত্রছাত্রীদের— সে-ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন দেশ-বিদেশের শিক্ষকদের। 

সমর বাগচী (Samar Bagchi)। এক কথায় তাঁর পরিচয় দেওয়া বেশ কঠিন। পেশাগতভাবে প্রযুক্তিবিদ এবং বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামের ডিরেক্টর এবং কিউরেটর হলেও, বাঙালি তাঁকে চিনেছে শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানের প্রচারক হিসাবে। অবশ্য সমাজকর্মী ও পরিবেশবিদ হিসাবেই নিজের পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন ক্যানসারে। হারিয়েছিলেন চলচ্ছক্তি। গতকাল ৯১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন কিংবদন্তি বাঙালি শিক্ষাবিদ।

আদ্যোপান্ত বাঙালি হলেও, ১৯৩২ সালে বিহারের পূর্ণিয়ায় জন্ম সমরের। বাবার কাজের সূত্রেই শৈশব এবং কৈশোর কেটেছিল বাংলার বাইরে। তবে ম্যাট্রিকুলেশন দেওয়ার পরই, হারাতে হয় বাবাকে। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৪৮ সালে সপরিবারে ফিরতে হয় কলকাতায়। আশ্রয় দিয়েছিল সাবেকি বাড়ি। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন উত্তর কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর পাড়ি দেওয়া ধানবাদে। ইন্ডিয়ান স্কুল অফ মাইনিং-এ খনিজ প্রযুক্তিবিদ্যায় অধ্যয়ন।

চাকরিও জুটে গিয়েছিল ঝাড়খণ্ডের এক কোলিয়ারিতে। ম্যানেজারের পদ। মাইনে মন্দ নয়। তবে আড়াই বছরের মধ্যেই রণে ভঙ্গ দিতে হল তাঁকে। কোমরের চোটই হয়ে উঠল কাল। ১৯৬২ সাল। কলকাতায় ফিরে যোগ দিলেন বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামের ধাতুবিদ্যা এবং খনিজ বিভাগের কিউরেটর হিসাবে। পরবর্তীতে এই মিউজিয়ামের পরিচালক হিসাবেও নিযুক্ত হন সমর। আজ বিড়লা মিউজিয়ামে গেলে যে কৃত্রিম কয়লাখনির দেখা মেলে, সেটিও তৈরি হয়েছিল তাঁর তত্ত্বাবধানেই। বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতে এ-ধরনের কৃত্রিম কয়লাখনি বিরল বললেই চলে। তবে শুধু বিড়লা মিউজিয়ামই নয়, তাছাড়াও পূর্বভারতের আরও চারটি সায়েন্স মিউজিয়ামে বিভিন্ন সময়ে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। শিক্ষাবিদের ভূমিকায় অবতরণ এরও বহু পরে। 

আশির দশকের কথা। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে দূরদর্শনে ‘কোয়েস্ট’ নামের এক বিশেষ বিজ্ঞান ভিত্তিক ক্যুইজ অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয় কলকাতার বিড়লা মিউজিয়াম। এই অনুষ্ঠানের সৌজন্যেই ছাত্রমহলে অত্যন্ত পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন সমর বাগচী। এমনকি এই অনুষ্ঠানের সূত্র ধরেই শিক্ষাজগতে জড়িয়ে পড়া তাঁর। 

আনুষ্ঠানিকভাবে বিড়লা মিউজিয়াম থেকে অবসর নেওয়ার পর, শুরু করেন এক নতুন লড়াই। কলকাতা-সহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের স্কুলে গিয়ে একটি বিশেষ সমীক্ষা চালান সমীর। লক্ষ করেন, বাংলার সমস্ত স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানো হলেও, ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ শেখানো হয় না শ্রেণিকক্ষে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ ক্লাসরুমে কীভাবে কম-খরচে দেখানো সম্ভব, সে-ব্যাপারেও সচেতন নন শিক্ষকরা। 

পরিস্থিতি বদলাতে নিজেই মাঠে নেমে পড়েন সমর। লক্ষ ছিল শিক্ষিকদের আধুনিক ও সাশ্রয়ী উপায়ে ব্যবহারিক বিজ্ঞানের প্রশিক্ষণ দেওয়া। বাংলা তো বটেই, একুশ শতকে গোটা ভারতজুড়ে শিক্ষকদের জন্য চারশোরও বেশি কর্মশালার আয়োজন করেন তিনি। কাশ্মীর থেকে শুরু করে আন্দামান-নিকোবর— তা এক্তিয়ার থেকে বাদ পড়েনি ভারতের কোনো রাজ্যই। তাছাড়াও দেশের বাইরে বিভিন্ন কর্মশালায় ভারতের প্রতিনিধি হয়েও হাজির থেকেছেন সমর। কখনও আবার মার্কিন মুলুকে আয়োজিত বিশেষ প্রদর্শনীতে তুলে ধরেছেন ভারতের ৫০০০ বছরের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস। প্রাচীন ভারতে কীভাবে সঙ্গীত কিংবা ভাষাতত্ত্বের সঙ্গেও জড়িয়ে ছিল বিজ্ঞান— সে-ব্যাপারে একাধিক প্রামাণ্য বক্তৃতাও রেখেছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। 

একইসঙ্গে প্রান্তিক বাংলায় বেশ কয়েকটি স্কুলেও সাম্মানিক শিক্ষক হিসাবে নিয়মিত পড়াতেন তিনি। শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতেন দরিদ্র ও আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। এমনকি মহামারী চলাকালীন সময়ে, অসুস্থ শরীরেও তিনি ছুটে গিয়েছিলেন বাঁকুড়ায়। ব্যক্তিগত উদ্যোগেই স্থানীয় কেবল টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞানের ক্লাস নেওয়া শুরু করেছিলেন বিষ্ণুপুরের এক স্থানীয় শিক্ষক। সেই খোঁজ পেয়ে সমরবাবুও হাত মিলিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। দিন কয়েকের জন্য বাঁকুড়ায় গিয়ে, হুইলচেয়ারে বসেই রেকর্ড করেছিলেন ব্যবহারিক বিজ্ঞানের বেশ কিছু ভিডিও। 

সবমিলিয়ে বলতে গেলে, ৯০-এর গণ্ডি পেরোলেও তাঁকে ছুঁতে পারেনি বার্ধক্য। শিক্ষাপ্রসারের বাইরেও নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতাই হোক কিংবা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ— শেষ বয়সেও বার বার রাস্তায় নামতে দেখা গেছে তাঁকে। গলা ফাটাতে দেখা গেছে তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে। আবার কখনো জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে স্কুল-পড়ুয়াদের নিয়ে নিজেই আয়োজন করেছেন মিছিলের। বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে এহেন দ্বিতীয় কোন বর্ণময় চরিত্র, ‘আধুনিক’ শিক্ষক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর আজকের দিনে, যিনি বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা প্রসারের পাশাপাশিই লড়েছেন বৈষম্যহীন, সুষ্ঠু সমাজ গড়ে তোলার জন্যও। ‘সুস্থ সমাজ না-গড়লে ভারতে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ পাবে না আগামী প্রজন্ম’, প্রায়শই এমন অভিভাবকসুলভ কথা শোনা যেন সমর বাগচীর মুখে। বলার অপেক্ষা থাকে না, নবতিপর ‘তরুণ’-এর প্রয়াণে অভিভাবক হারাল দেশের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী…

Powered by Froala Editor

More From Author See More