শুধু ভারত নয়, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়েই পূজিত হন দেবী সরস্বতী

‘জয় জয় দেবী, চরাচর সারে কুচযুগশোভিত…’

মাঘের বসন্তপঞ্চমীতে এই মন্ত্র আওড়ায় না, এ-বাংলায় এমন কচিকাচা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে দেবী সরস্বতীর এই বন্দনা। বাঙালির রূপকল্পনায় তিনি শ্বেত শাড়ি পরিহিতা, হাতে বীণা, সঙ্গে বাহন রাজহংস। শুধু বাঙালির রূপকল্পনাতেই নয়, পুরাণেও তো শ্বেতবসনা হিসাবেই বর্ণনা করা হয়েছে সরস্বতীকে (Devi Saraswati)। কিন্তু হঠাৎ যদি শাড়ির বদলে মোটা পশমের ওভারকোট চাপে তাঁর গায়ে? 

ভাবছেন, এ বুঝি মৃৎশিল্পীরই কোনো কল্পনা! থিমের দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে আজ এমনটা ঘটে যাওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। অবশ্য যদি প্রায় দেড় হাজার বছর পুরনো এহেন সরস্বতীমূর্তির সাক্ষাৎ পান, তবে অবাক হবেন বইকি। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতকে এই রূপেই পূজিতা হতেন দেবী সরস্বতী। যদিও সেটা বাংলায় কিংবা ভারতে নয়, সুদূর জাপানে। আর সে-দেশে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘বেনজাইতেন’ নামে। কিন্তু তিনিই যে সরস্বতীর অন্য রূপ, সে-ব্যাপারে নিশ্চয়তা কী? আর তা যদি হয়েও থাকে, তবে ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেবী সরস্বতী জাপানে পাড়ি জমালেন কীভাবে? 

বলতে গেলে, ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রাচীনতম পূজিতা দেবীদের মধ্যে অন্যতম দেবী সরস্বতী। যাঁর আরাধনা শুরু হয়েছে বৈদিক যুগ থেকে। সেখানে তিনি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী, জ্ঞানের দেবী। তিনি ব্রহ্মার শক্তির উৎসও বটে। প্রাচীন যুগ থেকেই ভারতীয় পুরাণে এবং তন্ত্রশাস্ত্রে অধিকাংশ দেবতারই শক্তির উৎস হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে কোনো দেবীকে। সরস্বতীর মতোই শিবের শক্তিও এক নারী— দুর্গা। ভারতীয় পুরাণের এই মাতৃযোগই হুবহু নিজেদের তন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছেন বৌদ্ধ উপাসকরা। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে বজ্রযান ও মহাযান শাখা। সেখানেই বাগ-দেবতা মঞ্চুশ্রীর শক্তির আধার দেবী সরস্বতী।

আরও পড়ুন
সরস্বতী পুজোর ধুমধাম শুরু যৌনপল্লীতেই, বঙ্কিম-হুতোমের ব্যঙ্গের শিকার কলকাতার বাবুরা

ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে দেবী সরস্বতীর বিদেশে পাড়ি দেওয়ার অন্যতম কারণ এই বৌদ্ধ ধর্মই। হিন্দু ধর্ম ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে বন্দি থাকলেও, বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। শুধু ধর্মই নয়, পাশাপাশি চিনের সঙ্গে প্রাচীন যুগ থেকে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কও এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের অন্যতম কারণ। সেই প্রবাহে দেবী সরস্বতীও পৌঁছে যান চিন, মায়ানমার, তিব্বত, জাপান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এমনকি ইন্দোনেশিয়ায়। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় তাঁর পরিচয়ও ভিন্ন ভিন্ন। 

আরও পড়ুন
মৃতপ্রায় সরস্বতী নদীকে বাঁচাতে বাঁধের পরিকল্পনা

তিব্বতে তাঁর পরিচয় ‘ইয়েং চেন মা’। তিব্বত যে বহুযুগ আগে থেকেই বৌদ্ধধর্মের অন্যতম পীঠস্থান, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা থাকে না। ফলত, বজ্রযান তন্ত্রানুসারে সরাসরিভাবেই সেখানের সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন সরস্বতী। সেখানেও তিনি শ্বেতবস্ত্রা, মঞ্জুশ্রীর সঙ্গিনী। এখানে আরও একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। মহাযানতন্ত্রে দেবী সরস্বতীর তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রূপ রয়েছে— কোথাও তিনি দ্বিভূজা, কোথাও আবার চতুর্ভূজা বা ষড়ভূজা। 

আরও পড়ুন
সরস্বতী পুজো ঘিরে বিতর্কে রবীন্দ্রনাথ-সুভাষ, চাকরি খোয়ালেন জীবনানন্দ

ইয়েং চেন মা 

 

এবার আরও একটু উত্তর-পূর্বে যাওয়া যাক। ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র চিন। সেখানে সরস্বতী পূজিত হন ‘বিয়ানসাইতিয়ান’ রূপে। মহাযানতন্ত্রে আর্য-সরস্বতীর যে চতুর্ভূজা রূপটি বর্ণিত হয়েছে, ইনি তাঁরই চৈনিক অ্যাডাপ্টেশন। দুই হাতে তিনি বীণাবাদনরতা, অন্য দু’হাতে রয়েছে পদ্ম এবং পুস্তক। আবার কোথাও তাই দক্ষিণ হস্তে পুস্তকের বদলে দেখা যায় হাতপাখাও। বৌদ্ধতন্ত্রানুসারে তিনি ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’। ‘সুবর্ণপ্রভাসুত্র’— বৌদ্ধগ্রন্থটিতে রয়েছে দেবী ‘বিয়ানসাইতিয়ান’-এর আরাধনার পদ্ধতিতে। চৈনিক পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হচ্ছে, সমগ্র চিন সাম্রাজের দায়িত্বে ছিলেন প্রতাপশালী চার চৈনিক সম্রাট। কী উপায়ে সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায়— বিয়ানসাইতিয়ান সেই শিক্ষাই দিয়েছিলেন তাঁদের। দেখতে গেলে, ঠিক এই জায়গাটাতেও অদ্ভুতভাবে মিল রয়েছে ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে। দেবী সরস্বতী বাকদেবী হলেও, তিনিই তো আদতে দণ্ডনীতির স্রষ্টা। 

বিয়ানসাইতিয়ান 

 

যাক সে কথা। চিন থেকেই জাপান সাগর এবং পীতসাগর পেরিয়ে এই দেবীর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে জাপানে। সেখানে ‘বিয়ানসাইতিয়ান’ হয়ে ওঠেন ‘বেনজাইতেন’। হ্যাঁ, যে-দেবীর বর্ণনা দিয়েই শুরু হয়েছিল এই আলোচনা। সরস্বতীর মতো আজও জাপানের বিভিন্ন স্কুল এবং বৌদ্ধ মিশনারিতে তাঁর আরাধনা হয় নিয়ম করেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই সংস্কৃতি এবং ভৌগলিক অবস্থানের বদলের ছাপ স্পষ্ট হয়েছে তাঁর রূপকল্পনাতেও। শাড়ির বদলে তাঁর গায়ে চেপেছে ভারি পশমের পোশাক। হাতে বীণার বদলে জায়গা নিয়েছে ম্যান্ডোলিনজাতীয় চারটি তার বিশিষ্ট জাপানি বাদ্যযন্ত্র, বিওয়া। ষষ্ঠ শতাব্দীর জাপানি পুঁথিতে উল্লেখ পাওয়া যায় দেবী বেনজাইতেনের। 

বেনজাইতেন 

 

তবে বেনজাইতেন শুধু সঙ্গীত কিংবা বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী নন, তিনি একাধারে শান্তি এবং জলপ্রবাহের দেবীও বটে। গোটা জাপানজুড়ে বিভিন্ন জলাশয়ের ধারে পূজিতা হন তিনি। বিশ্বাস বেনজাইতেন বসবাস করেন জলের গভীরে। সর্প এবং ড্রাগনযোগও রয়েছে তাঁর সঙ্গে। এ-কথা আরও বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল, স্কন্দপুরাণে দেবী সরস্বতী পাতালনিবাসী। ব্রহ্মার অনুরোধেই তিনি পাতাললোক থেকে উঠে এসেছিলেন মর্তে। তবে লোকচক্ষু থেকে তাঁকে আড়াল করতে ব্রহ্মা স্বয়ং একটি হ্রদ খনন করেন। সেই হ্রদের নিচেই আশ্রয় নেন দেবী সরস্বতী। পাশাপাশি দেবী সরস্বতীর নিরাপত্তার জন্য ব্রহ্মা নিয়োগ করেছিলেন সর্পরক্ষকদের। এও কি নিছকই কাকতালীয় মিল? 

ভারতের আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র মায়ানমারেও পূজিত হন সরস্বতী। সেখানেও বৌদ্ধ ধর্মের সূত্র ধরেই পৌঁছেছেন দেবী। বর্মায় তাঁর নাম থুরাথাডি। বিদ্যার দেবী হিসাবেই আরাধনা হয় থুরাথাডির। তবে মায়ানমারের পুরাণে তিনি কল্পিত হয়েছেন গ্রান্থাগারিক হিসাবে। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথির সংরক্ষক এবং চর্চার অধিষ্ঠাত্রী থুরাথাডি। আজও সেই আদলেই তৈরি হয় থুরাথাডির মূর্তি। তাঁর হাতে বীণার বদলে থাকে বইয়ের সম্ভার। ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও, চিন বা জাপানে সরস্বতী বন্দনা শুরু হওয়ার অনেক পরে মায়ানমারে পাড়ি দিয়েছিলেন দেবী। থুরাথাডির প্রাচীনতম লিখিত নথি বলতে যা পাওয়া যায়, সেটি একাদশ শতকের একটি বৌদ্ধ পুঁথি। তার আগে সে-দেশে থুরাথাডি সম্পর্কিত কোনো মৌখিক লোককথা বা শ্রুতির প্রচলন ছিল কিনা, তা বলা কঠিন।

থুরাথাডি 

 

যাই হোক, এতক্ষণ যে-সমস্ত দেবীদের কথা হচ্ছিল, তাঁদের সঙ্গে দেবী সরস্বতীর রূপ এবং দর্শনের মিল থাকলেও, একটি তফাৎ ছিল। আর তা হল বাহন। চিন, জাপান কিংবা তিব্বতে দেবী সরস্বতী হংসহীনা। সেই আক্ষেপ পূরণ হবে কম্বোডিয়ায় গেলে। চিন ও জাপানে সরস্বতীর সঙ্গে দেখা যায় ড্রাগনকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ড্রাগন মূলত নাগ বা সর্প। অবশ্য কম্বোডিয়ায় সরস্বতীর বাহন রাজহংস। যেমনটা দেখতে অভ্যস্ত আমরা সকলেই। একটা সময় কম্বোডিয়ায় হিন্দু ধর্মের উপাসনা হত বলেই হয়তো সরস্বতীর এমন সরাসরি রূপায়ন হয়েছে সে-দেশে। অঙ্করভাট মন্দির তো বটেই, তারও কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই কম্বোডিয়ায় একইসঙ্গে ব্রহ্মা এবং সরস্বতী আরাধনার চল রয়েছে। অষ্টম শতকের নথিতে, বিশেষত খেমার সাহিত্যে তার প্রমাণ মেলে। 

কম্বোডিয়ার দেবী সরস্বতী

 

কম্বোডিয়ার মতো ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডের ছবিও অনেকটাই এক। ইন্দোনেশিয়াতেও দেবীর বাহন রাজহংস। তবে থাইল্যান্ডে সরস্বতীর বাহন হাঁসের বদলে ময়ূর। পাশপাশি আরও এক বিচিত্র জিনিসের দর্শন মেলে থাইল্যান্ডে। তা হল, দেবীর গলায় মালার বদলে অ্যামুলেট। কথ্যভাষায় এটাকে ওই লাকি লকেট বললেও চলে। 

ইন্দোনেশিয়ার দেবী সরস্বতী

 

থাইল্যান্ডের দেবী সরস্বতী

 

এশিয়ার এই সরস্বতীবৃত্তান্তের শেষে এবার একটা মজার জিনিস জানিয়ে রাখা যাক বরং। বেনজাইতেন— জাপানের দেবী সরস্বতীর প্রতিরূপের কথা বলা হয়েছে আগেই। শেষবেলায় তাঁর আরও একটা ‘সুপারপাওয়ার’-এর কথা উল্লেখ না-করলেই নয়। জাপানিদের বিশ্বাস, প্রার্থনা করলে প্রণয়ের যোগও করিয়ে দেন বেনজাইতেন। কাজেই বহু মানুষই মনের গোপন ইচ্ছে নিয়ে দ্বারস্থ হন দেবীর কাছে। দেবীর মন্দিরের আশেপাশে সুতো বেঁধে ঝুলিয়ে আসেন ছোট্ট চিরকুট। সে-চিরকুটের ভেতরে লেখা থাকে প্রণয়-প্রার্থনা। এখানেই ইতি টানা যাক এই আলোচনায়। আপাতত ‘বসন্ত’ জাগ্রত দ্বারে। দেবীবন্দনার দিনটি যে এ-মুলুকে ভ্যালেন্টাইন ডে-ও বটে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More