যিশুর ঐতিহাসিক ছবি পুনরুদ্ধার করতে জন্ম ‘মিম’-এর

গির্জায় দেওয়ালে লাল জামা পরা স্থূলকায় একটি মানব প্রতিকৃতি। সারা মাথায় ঝাঁকড়া চুল। সরু বাঁশির মতো নাক চ্যাপ্টা। মণিহীন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ চোখ। মুখমণ্ডলে ঠোঁট নেই, নেই সুস্পষ্ট চিবুকও। এই ছবির ইতিহাস না-জানলে, যে-কেউ ঠাহর করবে সেটি হয়তো কোনো শিশুর আঁকা।

স্প্যানিশ শহর বোর্হায় অবস্থিত স্যাংচুয়ারি অফ মার্সি গির্জায় গেলেই দেখা মিলবে এমন আশ্চর্য এক ফ্রেস্কোর। বয়স প্রায় ৯০ বছর। প্রশ্ন থেকে যায়, এই ছবি যদি শিশুরই আঁকা হয়ে থাকে তবে তাকে সযত্নে গির্জার দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে কেন? ছবিটির নিরাপত্তার জন্য কেন বিশেষভাবে ব্যারিকেড লাগানো হয়েছে তার সামনে? ছবিতে প্রদর্শিত মানুষটিই-বা কে?

উত্তর, যিশু খ্রিস্ট (Jesus Christ)। চমকে উঠলেন? প্রথমবার শুনলে চমকে উঠবেন যে-কেউ। এ-ছবির সঙ্গে যে দূরদূরান্তের কোনো সম্পর্ক নেই যিশুর! ঝাঁকড়া চুল বা স্থূলকায় চেহারা— বাইবেলের কোনো অধ্যায়ের এমন বর্ণনা দেওয়া হয়নি তাঁর। তা-সত্ত্বেও ক্যাথোলিক গির্জার ভেতরে যিশুর এমন বিকৃত ছবি প্রদর্শিত হলে অবাক হতে হয় বৈকি। আসলে, জন্মলগ্নে এমন বিকৃত ছিল না এই ফ্রেস্কোতে প্রদর্শিত যিশুর প্রতিকৃতি। তবে?

১৯৩০ সাল। বোর্হার এই গির্জায় যিশু খ্রিস্টের ছবি এঁকেছিলেন স্প্যানিশ চিত্রকার এলিয়াস গার্সিয়া মার্টিনেজ। মার্টিনেজের ছবি শৈল্পিক ইতিহাসের দিক থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এমনটা নয় একেবারেই। বিশ শতকের সেরা চিত্রশিল্পীদের তালিকায় তাঁর নাম আসে না সচরাচর। তবে শিল্পী হিসাবে মোটেও মন্দ ছিলেন না তিনি। নিপুণ তুলির ছোঁয়াতেই বোর্হার গির্জার দেওয়ালে ফুটিয়ে তুলেছিলেন যিশুর ছবি। মাথায় কাঁটার মুকুট। একদৃষ্টে তিনি তাকিয়ে রয়েছেন শূন্যের দিকে। মার্টিনেজ ছবিটির নাম রেখেছিলেন ‘এক্কে হোমো’ (Ecce Homo)। অর্থাৎ ‘বিহোল্ড দ্য ম্যান’।

তবে কালের আবহেই ক্রমশ ফিকে হয়েছে এই ফ্রেস্কোর রং। গির্জার দেওয়ালে নোনা ধরায় ক্রমে ক্রমে রঙের পরত খসেছে ‘এক্কে হোমো’-র গা থেকে। অবশ্য গির্জার এই ঐতিহাসিক ছবি সংরক্ষণের জন্য কোনোদিনই সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি গির্জা কর্তৃপক্ষ। তার প্রয়োজনও পড়েনি খুব একটা। কারণ, বোর্হায় সবমিলিয়ে প্রায় হাজার দুয়েক মানুষের বাস। পর্যটকদের আনাগোনাও নেই বললেই চলে। তবে কার জন্য সংস্কার করা হবে এই ছবি?


গির্জার কর্তৃপক্ষ উপেক্ষা করলেও, ২০১২ সালে ক্ষয়িষ্ণু যিশুর রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন গির্জারই ৮৩ বছর বয়সি এক সন্ন্যাসিনী। সিসিলিয়া গিমেনেজ। সিসিলিয়া ছোটোবেলায় আঁকা শিখেছিলেন ঠিকই, তবে পেশাদার শিল্পী নন তিনি। এমনকি কৈশোরের পর চিত্রশিল্পর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও ছিল না সেভাবে। শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাস এবং যিশুর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাভক্তি থেকেই এই ছবি পুনরুদ্ধার ও সংস্কারের কাজ শুরু করেন তিনি। অবশ্য তার জন্য কোনোরকম অনুমতিও নেননি গির্জা কর্তৃপক্ষের থেকে। কেবলমাত্র গির্জার পাদ্রিকে জানিয়েছিলেন, এই ছবিকে সারিয়ে তুলতে চান তিনি। সিসিলিয়ার কথায় আমল না-দিয়েই সায় জানিয়েছিলেন পাদ্রি। আর তাতেই ঘটে যায় বিপত্তি।

পুরনো ছবি সারিয়ে তোলা তো দূরের কথা, সিসিলিয়ার তুলির আঁচড়ে সম্পূর্ণ বদলে যান যিশু। কাঁটার মুকুট পরিণত হয় কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুলে। চোখের ওপর প্রলেপ পড়ে গাঢ় কালো রঙের। সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ে দুটি চোখের অবস্থানও। এরপর গির্জা থেকে সপ্তাহ খানেকের ছুটি নিয়ে সিসিলিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে। 

ততক্ষণে যা বিপত্তি হওয়ার হয়ে গেছে। বিকৃত ছবিটি গির্জা কর্তৃপক্ষের নজরে আসতেই, সারা পড়ে যায় গোটা স্পেনে। ক্রমে ‘এক্কে হোমো’ জায়গা করে নেয় বিবিসি, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস-সহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতাতেও। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে অজস্র ‘মিম’। দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয় সিসিলিয়াকে। দাবি করা হয়, যিশুর ছবি আঁকতে গিয়ে বানরের ছবি এঁকেছেন তিনি। ‘এক্কে হোমো’-র বদলে বিকৃত ছবিটির পরিচয় হয়ে ওঠে ‘এক্কে মনো’। অর্থাৎ, ‘বিহোল্ড দ্য মাঙ্কি’। অবশ্য সে-সময় টেলিভিশনে একাধিকবার সাক্ষাৎকার দিতে এসে তিনি জানিয়েছিলেন, কোনোরকম খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না তাঁর। বরং, যিশুর প্রতি কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই, স্বয়ং এই ছবি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। 


মজার বিষয় হল, এই শৈল্পিক বিপর্যয়ই রাতারাতি খ্যাতির চূড়ায় তুলে দেয় বোর্হাকে। এই বিকৃত ছবি দেখতেই সেখানে ভিড় জমাতে থাকেন হাজার হাজার মানুষ। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বোর্হার এই গির্জায় গোটা বছরে বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে এসেছিলেন প্রায় ৬০ হাজার পর্যটক। ২০১৫ সালে সংখ্যাটা ছাড়িয়েছিল ২ লক্ষের গণ্ডি। তাতে বদলে যায় স্থানীয় অর্থনীতিও। উপার্জনের পথ খুঁজে পান বহু আঞ্চলিক ব্যবসায়ী। অন্যদিকে এই ছবি দেখার জন্য ৩ ইউরোর টিকিট কাটতে হত দর্শনার্থীদের। ফলে বিকৃত যিশুর সুবাদে আয় বেড়েছিল বোর্হার গির্জাটিরও। 

তবে এখানেই শেষ নয় এই গল্পের। ২০১৫ সালে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সিসিলিয়া নিজেও। দাবি করেছিলেন, তাঁর পুনরুদ্ধারের জন্যই বর্তে গেছে বোর্হা শহর ও গির্জার অর্থনৈতিক অবস্থা। সেক্ষেত্রে পুনরুদ্ধারকারী শিল্পী হিসাবে এই লাভের একাংশ তাঁরও প্রাপ্য। প্রাথমিকভাবে নানান আলোচনা-সমালোচনা হলেও, শেষ পর্যন্ত আদালত রায় দিয়েছিল সিসিলিয়ার পক্ষেই। আজও এই ছবির সৌজন্যে প্রাপ্ত লভ্যাংশের ৩৯ শতাংশ তুলে দেওয়া হয় সিসিলিয়ার পরিবারের হাতে। এমনকি ছবির নিচেও প্রদর্শিত হয় সিসিলিয়ার নাম। বলতে গেলে, এক অকল্পনীয় শৈল্পিক বিপর্যয়ই শেষ বয়সে ‘সেলেব্রিটি’ করে তুলেছিল তাঁকে…

Powered by Froala Editor