দু-পায়ে ‘হেঁটে’ বেড়াত যে-রেলগাড়ি!

বছর তিনেক আগের কথা। তখনও যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠেনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল এক আশ্চর্য ছবি। ইউক্রেনের অভিশপ্ত চের্নোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ এবং সমীক্ষা করছে এক বিশেষধরনের রোবট। তার চেহারা হুবহু কুকুরের মতোই। চাকার সাহায্যে নয়, বরং পায়ে হেঁটেই এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাচ্ছে এই চারপেয়ে রোবট-সারমেয়। কিন্তু এই প্রযুক্তিকেই যদি ব্যবহার করা হয় যানবাহনের ক্ষেত্রে? চাকার পরিবর্তে গাড়িতে জুড়ে দেওয়া হয় এ-ধরনের যান্ত্রিক পা?

নিঃসন্দেহে হাস্যকর হবে ব্যাপারটা, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে এই ভাবনা নতুন নয়। এমনকি আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগেই, আশ্চর্য বিদঘুটে এক যান তৈরি করেছিলেন এক স্কটিশ প্রযুক্তিবিদ উইলিয়াম ব্রান্টন (William Brunton)। তাও আবার সাধারণ গাড়ি নয়, একেবারে রেলগাড়ি। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে রেলগাড়ির লোকোমোটিভ ইঞ্জিন। ব্রান্টন এই ইঞ্জিনের নাম রাখেন ‘মেকানিক্যাল ট্রাভেলার’। তবে সে-যুগে লোকমুখে এই ইঞ্জিন পরিচিত ছিল ‘স্টিম হর্স’ (Steam Horse) এবং ‘ওয়াকিং রেল লোকোমোটিভ’ (Walking Rail Locomotive) নামেই। 

১৭৭৭ সালে স্কটল্যান্ডের লোচউইনোচে জন্ম এই স্কটিশ প্রকৌশলীর। বাবা ছিলেন সামান্য ঘড়ির দোকানের মেকানিক। প্রাথমিকভাবে তাঁর থেকেই প্রযুক্তিবিদ্যার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন ব্রান্টন। সেইটুকু বিদ্যে নেই কাজে নেমে পড়া। মাত্র ১৩ বছর বয়স তখন তাঁর। ক্লাইড নদীর তীরে অবস্থিত ‘নিউ ল্যানার্ক’ নামের এক কাপড় তৈরির কারখানায় ফিটার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন ব্রান্টন। 

এর প্রায় ছ-বছর পর কর্মক্ষেত্র বদল। বার্মিংহামের ‘বোল্টন অ্যান্ড ওয়াট সোহো ফাউন্ড্রি’-তে শুরু হয় তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। কিংবদন্তি স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটের অধীনে কাজ করার সুযোগও জুটে যায় তাঁর। বছর চারেকের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর ১৮০২ সালে পদোন্নতি। এই সংস্থায় ইঞ্জিন বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্ট হয়ে ওঠেন ব্রান্টন। সে-সময় জেমস ওয়াটকে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন তিনি। বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতি। 

এই সংস্থায় দীর্ঘ ১০ বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর ডার্বিশায়ারে পাড়ি দেন ব্রান্টন। যোগ দেন স্টিম ইঞ্জিন সংস্থা বাটারলি ওয়ার্কসে। সেখানে গিয়ে বেঞ্জামিন আউটরাম, উইলিয়াম জসপে, জন রেনি, টমাস টেলফোর্ডের মতো প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে পরিচিতি গড়ে ওঠে ব্রান্টনের। তাঁদের টেক্কা দিতেই শুরু করেন নিজস্ব রেল ইঞ্জিন তৈরির কাজ। কেমন হবে সেই ইঞ্জিন? 

ব্রান্টন লক্ষ করেছিলেন, বয়লারে জ্বালানির জোগান অব্যাহত রাখতে ছোটো ছোটো ট্রলি করে কয়লা বহন করে নিয়ে আসেন শ্রমিকরা। সে ট্রলির নিচে চাকা থাকলেও, তা স্বয়ংক্রিয় নয়। বরং, চাকাযুক্ত এই গাড়িকে দৈহিক বল প্রয়োগ করেই এগিয়ে নিয়ে যান শ্রমিকরা। এখন যদি এই শ্রমিকদেরই বদলে ফেলে যায় যন্ত্রমানবে? 


হ্যাঁ, এমন একটি ভাবনা থেকেই অদ্ভুতদর্শন ‘ওয়াকিং লোকোমোটিভ’-এর চিন্তাভাবনা মাথায় আসে ব্রান্টনের। ট্রলির মতোই এই লোকোমোটিভ ইঞ্জিন চলত চারটি চাকার ওপর ভর দিয়ে। তবে তার চালিকা শক্তির যোগান দিত প্রকাণ্ড দুটি ধাতব যান্ত্রিক পা। বয়লারে জল ফোটানোর মাধ্যমে তৈরি স্টিম বা বাষ্পের চাপেই সেগুলি হাঁটত হুবহু মানুষের মতোই। সামনের দিকে ঠেলে দিত ইঞ্জিনকে। 

১৮১৩ সাল। বাটারলি-তে থাকাকালীনই ক্রিচে শহরের খনি থেকে চুনাপাথর উত্তোলনের জন্যই ‘মেক্যানিক্যাল ট্রাভেলার’ নামের এই বিশেষ রেলইঞ্জিন তৈরি করেন ব্রান্টন। অবশ্য অত্যন্ত ধীর গতিতেই চলত তাঁর তৈরি এই রেল। 

ধীর গতি কিংবা হাস্যকর আকৃতির জন্য ব্রান্টনের এই মডেল নিয়ে প্রাথমিকভাবে হাসি-ঠাট্টা হলেও, এই ইঞ্জিনের দুটি প্রোটোটাইপ কাজে লাগানো হয় ক্রিচ শহরের খনিতে। দীর্ঘ দু-বছরেরও বেশি সময় যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গেই কাজ করেছে সেগুলি। বড়ো বড়ো চুনা পাথরের ব্লক টেনে নিয়ে গেছে ৩ ঘণ্টা প্রতি মাইল গতিবেগে। পরবর্তীতে বার্টন নিউবোটল কোলিয়ারিতেও একই ধরনের বৃহত্তর একটি ‘স্টিম হর্স’ ইঞ্জিন তৈরি করেন ব্রান্টন। ১৮১৪ সালে কাজ শুরু করেছিল সেই ইঞ্জিন। 

অবশ্য প্রাথমিকভাবে সাফল্য পেলেও, পরীক্ষামূলক স্তরেই আটকে থেকে যায় তাঁর তৈরি এই চলমান ইঞ্জিন। বাণিজ্যিকভাবে এই ইঞ্জিনের উৎপাদন হয়নি কোনোদিনই। ১৮১৫ সাল। ফিলাডেলফিয়া, কাউন্টি ডারহাম, ইংল্যান্ড-সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কয়লা খনিতে শুরু হয় শ্রমিক আন্দোলন। বার্টন নিউবোটল কোলিয়ারিতেও অন্যথা হয়নি তার। সেখানে এই বিক্ষোভের সময়ই দুর্ঘটনাবশত বিস্ফোরিত হয় ব্রান্টনের তৈরি ওয়াকিং লোকোমোটিভের বয়লার। আহত ও নিহত হন বেশ কিছু শ্রমিক এবং বিক্ষোভকারী। এই ঘটনার পর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় ব্রান্টনের নকশাটিকেই। চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যায় তার পথচলা।

অবশ্য ব্রান্টন থেমে থাকেননি সেখানেই। প্রযুক্তিবিদ্যার দুনিয়ায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তার নাম। বাষ্পের সাহায্যে নেভিগেশন, কলকারখানার আধুনিকতর যন্ত্র, পাখার গতি নিয়ন্ত্রক, স্টিমারের ইঞ্জিন তৈরি-সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন তিনি। এমনকি লিভারপুলে ফেরি হিসাবে চলা প্রথম যন্ত্রচালিত নৌকাটিও ছিল তাঁরই তৈরি করা। সবমিলিয়ে গোটা কর্মজীবনে ৯টি উদ্ভাবনীর জন্য পেটেন্ট পেয়েছিলেন ব্রান্টন। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি আজও ব্যবহৃত হয় আমাদের দৈনন্দিনের জীবনে। তবে সে-কথা জানা নেই অধিকাংশ মানুষেরই। বরং, ব্রান্টনকে আজও অমর করে রেখেছে কেবলমাত্র ‘স্টিম হর্স’।

Powered by Froala Editor