অখণ্ড থাকুক বাংলা, চাননি নেহরু-প্যাটেল-শ্যামাপ্রসাদ

শেষ পর্ব

বাংলা ভাগ আটকানোর জন্য ২০ মে, ১৯৪৭ সালে তৈরি হয় ‘বসু-সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাব’। তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন সোহরাওয়ার্দী, কিরণশঙ্কর রায় আর শরৎচন্দ্র বসু – এই তিনজন চেষ্টা করেন মুসলিম লীগ আর কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের সমর্থন সংগ্রহের। জিন্নার সমর্থন থাকলেও, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতারা তীব্র বিরোধিতা করেন অখণ্ড বাংলার পরিকল্পনার।

প্রথম পর্ব
যেভাবে বাংলা ভাগ আটকাতে চেয়েছিলেন নেতাজির দাদা

পাশাপাশি, ব্যক্তিগতভাবে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বাংলার কংগ্রেস নেতাদের চিঠি লিখে বাংলা ভাগের দাবিতে অটল থাকতে বলেন। এবং যাঁরা অখণ্ড বাংলা চাইছিলেন, তাঁদের নিন্দা করেন প্যাটেল। নেহরুও চাননি, বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হোক। ফলে, কংগ্রেসের এই দুই শীর্ষ নেতা বাংলা ভাগকেই সমর্থন করে এসেছেন।

হিন্দু প্রধান জেলাগুলিতে, বাংলাভাগের সমর্থনে ৫৮টি ও বিরুদ্ধে ২১টি ভোট পড়ে। অথচ, মুসলিম প্রধান জেলাগুলিতে বাংলাভাগের বিপক্ষে ১০৫টি ও সমর্থনে ৩৫টি ভোট।

ততদিন সুর চড়িয়েছে কলকাতার সংবাদপত্রগুলিও। তাদেরও দাবি, বাংলা ভাগ হোক। এ-ব্যাপারে জোরালো প্রচার চালায় হিন্দু মহাসভা। কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভার নেতারা মিলিত হয়ে সোহরাওয়ার্দীর অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। তাঁরা চাইছিলেন, বাংলা ভাগ হোক এবং বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ভারতের মধ্যে থাকুক। এ-ব্যাপারে বাঙালি হিন্দুদের সমর্থনও আদায় করেন তাঁরা। হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ২ মে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে একটি চিঠিতে লেখেন – ‘একটি স্বাধীন ও অবিভক্ত বাংলা সম্পর্কে কিছু এলোমেলো কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এর ভাবার্থ আমাদের কাছে একেবারেই বোধগম্য নয় এবং আমরা কোনোভাবেই এর সমর্থন করি না। হিন্দুদের জন্য এই পরিকল্পনা কোনো উপকারে আসবে না।’

পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭-এর সেই দিনগুলোতে ছিলেন কলকাতায়। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে লিখেছেন –

বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা একটি ফর্মুলা ঠিক করেন। ...যতদূর আমার মনে আছে, তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তান না পাকিস্তানে যোগ দেবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। ...এই ফর্মুলা নিয়ে জনাব সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু দিল্লিতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে যান। শরৎ বসু নিজে লিখে গেছেন যে জিন্নাহ তাঁকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোনো আপত্তি নাই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। …শরৎ বাবু কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে যেয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল তাঁকে বলেছিলেন, “শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই।” মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত নেহরু কোন কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে সরদার প্যাটেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

তবু, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার এত বিরোধিতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার বাংলা-বিভাগের বিষয়ে নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায়নি। ১৭ মে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, বাংলা বিভাজন সম্পর্কে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদকে দুটি ভাগে ভাগ করা হবে। একটি ভাগ মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাগুলির প্রতিনিধিত্ব করবে, অন্য ভাগটি হিন্দু সংখ্যাগুরু এলাকার। এই জেলাগুলির নির্বাচিত সদস্যরা পৃথকভাবে ভোট দেবেন। ভোটের ফলাফলে যদি যে-কোনো একটি পক্ষও বাংলার বিভাজন চায়, তাহলে বাংলা ভাগ হবে। নইলে, উভয় পক্ষই যদি বাংলাভাগের বিপক্ষে ভোট দেয়, অখণ্ড থাকবে বাংলা।

ভোটের ফলাফল অবাক করার মতো। হিন্দু প্রধান জেলাগুলিতে, বাংলাভাগের সমর্থনে ৫৮টি ও বিরুদ্ধে ২১টি ভোট পড়ে। ফলে, সেখানেই নির্ধারিত হয়ে যায় বাংলার পরবর্তী ভাগ্য। অথচ, মুসলিম প্রধান জেলাগুলিতে এই ভোটের ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। সেখানে বাংলাভাগের বিপক্ষে ১০৫টি ভোট ও সমর্থনে ৩৫টি ভোট। অর্থাৎ, তারা চাইছিল, বাংলার বিভাজন যেন না হয়। কিন্তু পূর্ব শর্ত অনুযায়ী, একটি পক্ষ বিভাজনের সমর্থনে ভোট দেওয়ায়, স্থির হয়ে যায় যে, বাংলা ভাগ হচ্ছেই।

সুভাষচন্দ্র যদি তখন বাংলা তথা ভারতের রাজনীতিতে বর্তমান থাকতেন, তাহলে কি আদৌ বাংলা ভাগ হত?

এরপরের ঘটনাপ্রবাহ খুবই দ্রুত। ২০ জুন ১৯৪৭ সালে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে বাংলাকে দু’টুকরোয় ভাগ করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এবং পরবর্তীকালে বিতর্কিত সীমাও নির্ধারিত হয়। ১৫ আগস্ট আবহমানকালের দু’ভাগে ভেঙে যায় বাংলা। আর এর জন্য যত না ব্রিটিশ সরকার দায়ী, তার থেকেও বেশি দায়ী পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সদস্যরা। তাঁরা যদি এই ভাগের বিপক্ষে ভোট দিতেন, হয়তো অন্যরকম কিছু হত। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে শুধুমাত্র বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র জন্ম নিত ১৯৪৭-এই।

পাশাপাশি, একুশ শতকের বাঙালি-মনে আরেকটা প্রশ্নও ঘোরাফেরা করে। সনাতন ও অবশ্যম্ভাবী সেই প্রশ্ন। হোসেন সোহরাওয়ার্দী বাংলা অখণ্ড রাখার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। শরৎচন্দ্র বসু চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি তিনিও। কিন্তু, শরৎচন্দ্র বসু-র ভাই, সুভাষচন্দ্র যদি তখন বাংলা তথা ভারতের রাজনীতিতে বর্তমান থাকতেন, তাহলে কি আদৌ বাংলা ভাগ হত? মানুষটা তেমন হতে দিতেন কি?

সম্ভাবনা বলে, না। আর ওই একটি ‘না’-এর দিকে তাকিয়ে অনেক দীর্ঘশ্বাস পাক খায় আজও, বাঙালি জানে...

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)


Powered by Froala Editor