ওজন কমাতে শুরু খেলাধুলা, জ্যাভলিন ভারতের নতুন তারকা নীরজ

ছোটো থেকে মৌমাছির চাক ভেঙে মধু চুরি, আমগাছে ঢিল ছুঁড়ে আম চুরি আর বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি, এই ছিল তাঁর দৈনন্দিন কাজ। গায়ের জোরটা ছিল বরাবরই বেশি। বাড়ির সবার আদরের ছেলে। নীরজ চোপড়া। হরিয়ানার পানিপথ জেলার খান্দরা গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের ছেলে নীরজ। খেলার জগতে যিনি নতুন করে পরিচিত করেছেন ভারতকে। নীরজের আগে জ্যাভলিন থ্রোয়িং প্রতিযোগিতায় ভারতের কেউ এমন ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা, নীরজ নিজেও ছোটো থেকে জানতেন না, এমন একটা খেলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন তিনি। জ্যাভলিন থ্রোয়িং প্রতিযোগিতা তো দূরের কথা, জ্যাভলিন নিয়ে যে খেলা হয় তাই জানতেন না নীরজ।

গ্রামের ছেলে নীরজ। খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে তাই ‘ডায়েট কন্ট্রোল’ নামক শব্দটার কথা কোনোদিন শোনেননি। চুরি করে আচার, চুরমুর খাওয়া তো লেগেই থাকত। আর রাতের খাবার সময় ঠাকুমা আদর করে ঘি মাখিয়ে দিতেন রুটির উপরে। এভাবে খাওয়া-দাওয়া করতে করতে দেখতে দেখতে ওজন বেড়ে যায় নীরজের। প্রথম প্রথম অবশ্য বাচ্চা ছেলের নাদুসনুদুস চেহারা পরিবারের সবারই ভালো লাগত। কিন্তু ১২ বছর বয়সেই দেখা গেল তার ওজন হয়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ কেজি। ডাক্তারের কাছে যেতেই ডাক্তার নিয়মিত খেলাধুলোর পরামর্শ দিলেন। আর সেই থেকেই শুরু নীরজের যাত্রা। অন্য সব খেলার চেয়ে জ্যাভলিন থ্রোয়িং-কেই বেশি ভালোবেসে ফেললেন নীরজ। এর মধ্যে যে সেই ছেলেবেলার মৌচাক থেকে মধু চুরির একটা গন্ধ আছে।

নিছক শরীরচর্চার কারণে খেলাধুলোয় যোগ দেওয়া। ক্রমে তাই হয়ে উঠল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। স্বপ্ন আরও জোরদার হল ২০১৬ সালের সাউথ এশিয়ান গেমসে। সবাইকে অবাক করে সোনা জিতলেন নীরজ। আর ১৮ বছরের সেই তরুণের জ্যাভলিন অতিক্রম করল ৮২.২৩ মিটার দূরত্ব। যা সেই সময় সারা ভারতের রেকর্ড। এরপর সেই বছরেই পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড আন্ডার-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের রেকর্ড ভেঙে ফেললেন নীরজ। ৮৬.৪৮ মিটার দূরত্বে জ্যাভলিন ছুঁড়ে তৈরি করলেন অনুর্ধ্ব-২০ বিভাগের নতুন বিশ্বরেকর্ড। ২০১৭ সালে এশিয়ান গ্র্যান্ডপিক্সে ব্রোঞ্জ, এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা। সেইবছরই লন্ডনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ১৫ তম স্থান অধিকার করলেন নীরজ। ২০১৮ সালে কমনওয়েলথ গেমসেও সোনা। আর সেই বছরই এশিয়ান গেমসে নতুন করে রেকর্ড তৈরি করলেন নীরজ। এবারে অতিক্রান্ত দূরত্ব ৮৮.০৬ মিটার।

একের পর এক প্রতিযোগিতায় নীরজের সাফল্য নতুন করে ভাবতে বাধ্য করল ভারতের ক্রীড়াবিভাগকে। এতদিন জ্যাভলিন থ্রোয়িং-এর মতো খেলার দিকে বিশেষ নজর দেননি কেউই। নীরজের সাফল্য যেন একটা অজানা সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল। কিন্তু নীরজ নিজে ততদিনে খেলা থেকে যেন একটু গুটিয়ে নিতে চাইছেন নিজেকে। আর কিছু না, দরিদ্র্য কৃষক পরিবারের ছেলে তিনি। এদিকে বাবার শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। রোজগারের হাল ধরতে হবে যে তাঁকে। কিন্তু নীরজের খেলা বন্ধ হয়নি। বিশেষ সম্মান দিয়ে তাঁকে নিয়োগ করা হল ভারতের সেনাবিভাগে। কিন্তু এই ৩ বছর ধরে তাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেক প্রত্যাশা। টোকিও অলিম্পিকে ভারতের মুখ রাখবেন তিনি। প্রতিশ্রুতি রেখেছেন নীরজ চোপড়াও। গ্রুপলিগে সবাইকে হারিয়ে প্রথম স্থানে নীরজ। ৮৬.৬৫ মিটার দূরত্বে জ্যাভলিন ছুঁড়ে অনায়াসে টপকে গিয়েছেন সেমিফাইনালও। এখন তাঁর প্রথম অলিম্পিকে রুপোজয় নিশ্চিত। লড়াই এখন সোনার জন্য। ২০০৮ সালে অভিনব বিন্দ্রার পদকই ছিল অলিম্পিকে ভারতের শেষ একক সোনা। ১৩ বছরের প্রতীক্ষার শেষে নীরজ কি আবারও সোনা আনতে পারবেন? সেই দিকেই তাকিয়ে আছেন ১৩০ কোটি ভারতবাসী।

Powered by Froala Editor