শুধু খেলাই নয়, বারবার রাজনৈতিক প্রতিবাদের মঞ্চও হয়ে উঠেছে অলিম্পিক

/১১

১৯০৬ সাল। অলিম্পিকের আয়োজন সেবার গ্রিসের এথেন্স শহরে। এতদিন পর্যন্ত খেলোয়াড়রা এককভাবে বা দলবদ্ধভাবে অলিম্পিকের জন্য নাম নথিভুক্ত করতেন। এই প্রথম সমস্ত দেশের জন্য তৈরি হয়েছে জাতীয় অলিম্পিক কমিটি। প্রতিটা দেশের পতাকায় সেজে উঠেছে অলিম্পিকের ময়দান। কিন্তু এ কী! বিখ্যাত অ্যাথেলিট পিটার ও’কন্নর মাঠে প্রবেশ করছেন একটি নিজস্ব পতাকা নিয়ে। ২০ ফুট লম্বা দণ্ডের উপর সবুজ পতাকা। তার উপর লেখা, ‘এরিন গো ব্রাঘ’ বা আয়ারল্যান্ড ফরএভার।

/১১

এমন একটা সময়, যখন সমস্ত আয়ারল্যান্ডজুড়ে জ্বলছে স্বাধীনতার আগুন। কিন্তু আয়ারল্যান্ড কোনো স্বাধীন দেশ নয়। তাই খাতায় কলমে ও’কন্নর নেমেছিলেন ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় হিসাবেই। অথচ নিজস্ব পতাকা দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি আসলে একজন আইরিশ খেলোয়াড়। ইংল্যান্ডের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি নন তিনি।

/১১

এরপর অলিম্পিকের আয়োজনে নানা প্রশাসনিক পরিবর্তন ঘটে যায়। রাজনৈতিক চাপানউতোর থেকে দূরে সরে থাকতে চেয়েছেন অলিম্পিক কর্তারা। অথচ ১৯৬৮ সালে ঘটে গেল আরেক ঘটনা। মেক্সিকো সিটি অলিম্পিক্সের পোডিয়ামে পদক নিতে উঠে নিজেদের হাত মুঠো করে উপরে তুলে ধরলেন আমেরিকার রানার জন কার্লোস এবং টমি স্মিথ। দুজনেই কৃষ্ণাঙ্গ।

/১১

এদিকে তখন আমেরিকাজুড়ে বর্ণসাম্য আন্দোলনের আগুন জ্বলছে। কয়েক সপ্তাহ আগেই হত্যা করা হয়েছে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে। আর নিজেদের প্রতিবাদের মঞ্চ হিসাবে অলিম্পিকের পোডিয়ামকেই বেছে নিয়েছিলেন কার্লোস এবং স্মিথ। এমনকি তাঁদের সমর্থন জানিয়েছিলেন একই পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড় পিটার নর্ম্যান। এরপর কার্লোস এবং স্মিথকে বয়কট করেছিল আমেরিকার ক্রীড়াবিভাগ। নর্ম্যানও ১৯৭২ সালের অলিম্পিকে অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু সেদিন এক ইতিহাস তৈরি করেছিলেন তাঁরা তিনজন।

/১১

শুধুই বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলন নয়, ১৯৬৮ সালে আরও এক প্রতিবাদ উঠে এসেছিল অলিম্পিকের আসরে। আর সেই প্রতিবাদটি করেছিলেন চেকোস্লোভাক জিমন্যাস্ট ভেরা ক্লাসাভস্কা। সেই বছরই সোভিয়েত রাশিয়ার রেড আর্মি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চেকোস্লোভাকিয়ার উপর। একের পর এক সামরিক সংঘর্ষ তো চলছেই, সেইসঙ্গে বিপন্ন হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের জীবন। ভেরার মতো খেলোয়াড়দের অলিম্পিকের আগের নূন্যতম অনুশীলনের ব্যবস্থাটুকুও করতে দেয়নি বলসেভিক সরকার।

/১১

আর এই সমস্ত কারণেই রাশিয়ার পতাকাকে নিজের পতাকা বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন ভেরা। পদক নেওয়ার সময় রাশিয়ার পতাকার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য এর ফলে তাঁর খেলার কেরিয়ার একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী ২ দশক কোনো কোচিং পর্যন্ত করাতে পারেননি ভেরা। অবশেষে সোভিয়েতের পতনের পর আবারও খেলার জগতে ফিরে আসতে পেরেছিলেন তিনি।

/১১

তবে শুধুই যে খেলোয়াড়দের একক প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠেছে অলিম্পিক, এমনটা নয়। অলিম্পিককে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করেছে নানা রাষ্ট্রও। যেমন ১৯৮০ সালে মস্কো অলিম্পিক বয়কট করে আমেরিকা। এর আগের বছরই আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালায় রাশিয়া। আফগানিস্তানের অধিকাংশ মানুষ এই অভিযানকে সমর্থন করলেও আমেরিকার মতো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাছে তা ছিল অশনিসংকেত। যেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেতে চলেছে চিরকালের জন্য।

/১১

এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই রাশিয়ায় আয়োজিত অলিম্পিক বয়কটের ডাক দেয় আমেরিকা। সঙ্গে যোগ দেয় পশ্চিম জার্মানি এবং জাপানও। এমনকি কোনো খেলোয়াড় একক উদ্যোগে অলিম্পিকে অংশ নিতে চাইলে তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করা হবে বলেও জানিয়ে দেয় মার্কিন ক্রীড়াবিভাগ। পরেরবার অলিম্পিকের আয়োজন হয় লস অ্যাঞ্জেলসে। আগের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে এবার অলিম্পিক বয়কটের ডাক দেয় রাশিয়াও।

/১১

আবার অন্য দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি সমর্থনের বার্তাও উঠে এসেছে অলিম্পিকের ময়দানে। ২০০৪ সালে অলিম্পিক ফাইনাল থেকে সরে দাঁড়ালেন ইরানের জুডো চ্যাম্পিয়ন আরাশ মিরেসেমাইলি। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ইজরায়েলের ইহুদ ভাক্স। আরাশের পদকজয় প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে কোনো ইজরায়েলি প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়াইয়ে নামবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন আরাশ। প্যালেস্তাইনের ঘনঘন সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।

১০/১১

এই একই পথ ধরে এবছর আবারও উত্তপ্ত অলিম্পিকের আসর। পদক নিতে উঠে মুঠো হাত ক্রস করে ‘এক্স’ চিহ্ন তুলে ধরেন আমেরিকার শর্ট-পুটার র্যা ভেন সন্ডার্স। স্বাভাবিকভাবেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে নানা মহলে। অলিম্পিক কমিটি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এই খেলার আসর কোনো রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার জায়গা নয়। অন্যদিকে সন্ডার্সের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আমেরিকা সহ নানা দেশের খেলোয়াড়রা। সন্ডার্সের বক্তব্য, সারা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষদের অধিকারের লড়াইয়ের সমর্থনেই তাঁর এই প্রতিবাদ। আর এই প্রতিবাদের চিহ্নও তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের মিলিত আলোচনার ভিত্তিতেই।

১১/১১

অলিম্পিক কমিটি চায় সন্ডার্সকে বহিষ্কার করুক মার্কিন ক্রীড়াবিভাগ। অথচ সবাইকে অবাক করে আমেরিকার ক্রীড়াবিভাগ জানিয়েছে, সন্ডার্সকে সমর্থন করে গোটা দেশ। সারা পৃথিবীর কৃষ্ণাঙ্গ, ভিন্ন যৌনতার এবং মানসিক বৈচিত্রযুক্ত মানুষের সমান অধিকারের লড়াইকে সমর্থন জানিয়ে তাঁরা বলেছেন, বহিষ্কারের কোনো প্রশ্নই নেই। বরং সন্ডার্সকে এই কাজের জন্য বিশেষ সম্মান জানাতে প্রস্তুত তাঁরা। বিতর্ক যেদিকেই এগোক, সমালোচনার ঝড় যেভাবেই বইতে থাকুক, অলিম্পিক যে বারবার রাজনৈতিক প্রতিবাদের আন্তর্জাতিক মঞ্চ হয়ে উঠেছে, একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই।

Powered by Froala Editor

More From Author See More