আচমকাই ঘুমিয়ে পড়েন দুই গ্রামের মানুষ, আজও অজানা এর কারণ

‘আয় ঘুম যায় ঘুম, দত্তপাড়া দিয়ে’। দত্তপাড়া নয়, এ অন্য দুটি গ্রামের গল্প। যদিও বাংলার প্রচলিত প্রবাদের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় গ্রামগুলির পরিস্থিতি। এখানকার মানুষরা যেখানে-সেখানে, যখন-তখন আচমকাই ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের নেশা যেন গ্রামদুটিকে সর্বক্ষণ জড়িয়ে রেখেছে। যার কারণ আজও অজ্ঞাত!

কথা হচ্ছে কাজাকস্থান (Kazakhstan) দেশের কালাচি (Kalachi) আর ক্রাস্‌নোগোর্স্ক গ্রামদুটিকে নিয়ে। অবশ্য দ্বিতীয় গ্রামটির খানিকটা অংশ রাশিয়ারও অন্তর্গত। সে জটিলতা থাক। দুটি গ্রাম মিলিয়ে বাসিন্দার সংখ্যা সর্বসাকুল্যে মাত্র ৮০০। ২০১৩ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই চলছিল তাঁদের জীবনযাত্রা। হঠাৎ দেখা গেল এক ‘রহস্যময় ঘুমরোগ’-এর (Sleeping Syndrome) শিকার হয়ে পড়েছেন তাঁরা। অকারণেই রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে তাঁদের চোখে। কোনো নির্দিষ্ট সময় বা স্থানের বালাই নেই। হয়তো কোনো কাজ করছেন কিংবা রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছেন। তারপর নিজের অজান্তেই ঢলে পড়ছেন ঘুমের দেশে। 

আতঙ্কে গ্রামবাসীর স্বাভাবিক ঘুম উড়ে গেল। দু-বছরের মধ্যে ‘ঘুম রোগে’ আক্রান্ত হলেন প্রায় ১৪০ জন। ঠিক যেন ঘুম নয়! ঘুম আর জ্ঞান হারানোর মাঝামাঝি এক অবস্থা। এঁদের মধ্যে কারোর হয়তো তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল, আবার কেউ ঘুমিয়ে রইলেন টানা ছয়দিন। ঘুমের মধ্যে তাঁরা অদ্ভুত আচরণ করেছেন, প্রলাপ বকেছেন। ঘুম থেকে ওঠার পর শুরু হচ্ছে অসহ্য মাথাব্যথা আর বমি। মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত শক্তি যেন কেউ শুষে নিয়েছে। কেউ বা ঘুমের মধ্যে ভেবেছেন সারা মুখে যেন একটা শামুক ঘুরে বেরোচ্ছে। এরকম একাধিক ঘটনা দেখা গেল, যেখানে দীর্ঘ ঘুম থেকে ওঠার পর ঘুমন্ত ব্যক্তি তাঁর অতীতের সমস্ত স্মৃতি ভুলে গেছেন। ক্রমে শুধু মানুষের মধ্যে এই ‘রোগ’ সীমাবদ্ধ রইল না। বিড়ালের মতো গৃহপালিত পশুরা পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করল যেখানে-সেখানে।

পুরো বিষয়টা নিয়ে কাজাকিস্তান সরকারের ‘ঘুম’ ভাঙে একটু দেরিতে। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল, এই অঞ্চলের জলে বা মাটিতে মিশে থাকা কোনো রাসায়নিক পদার্থের জন্য এরকম ঘটনা ঘটছে। একটা মত এরকমও ছিল যে, এই অঞ্চলের লোকেরা ভেজাল মদ পান করে ‘আশ্চর্য ঘুমরোগ’-এর শিকার হয়েছেন। শেষপর্যন্ত কাজাকস্থান সরকার একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠায় কালাচি গ্রামটিকে পরীক্ষা করার জন্য। 

আরও পড়ুন
টানা ১১ বছর ঘুম! চমকে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ তরুণী

আরও পড়ুন
একটানা ২৫ দিন ঘুম, তার মধ্যেই স্নান-খাওয়া— রাজস্থানের ‘কুম্ভকর্ণে’র গল্প

২০১৫ সালে কাজাকস্থানের উপ-প্রধানমন্ত্রী বার্ডিবেক সাপারবায়েভ ঘোষণা করেন যে সমস্ত রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞ দলের গবেষণা অনুযায়ী ওই অঞ্চলের কাছাকাছি একটি পরিত্যক্ত ইউরেনিয়ামের খনি রয়েছে। যদিও সেটা ১৯৯০ সাল থেকে বন্ধ। তবুও মাঝেমাঝে সেখান থেকে কার্বন-মনোক্সাইড নির্গত হয়ে কালাচির বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা অনেকটা কমিয়ে দেয়। সেই দূষিত কার্বন-মনোক্সাইড প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেই গ্রামবাসীরা ‘ঘুমরোগ’-এর শিকার হয়ে পড়ছেন। 

যদিও এই যুক্তি মানতে সবাই প্রস্তুত ছিল না। তাঁদের মধ্যে নাজারদায়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ঠিক করেন ওই গ্রামদুটিকে সরেজমিনে পরীক্ষা করবেন। তাঁদের গবেষণা অনুযায়ী গ্রামগুলির জলে কোনো বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ মিশে গেছে। যেগুলি সাধারণত সেনাবাহিনী ব্যবহার করে। কিন্তু কী সেই রাসায়নিক পদার্থ বা কীভাবে সেই পদার্থ গ্রামগুলিতে এল, তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

ফলে রহস্য আজও রহস্য থেকে গেছে। সরকার থেকে গ্রামবাসীদের অন্য নিরাপদ অঞ্চলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গবেষণা জারি থাকলেও আদৌ এই রহস্যের কোনো সমাধান পাওয়া যাবে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

Powered by Froala Editor